নিউজ ডেস্কঃ
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন রক্ষায় ইউনেসকোর শর্ত ও সুপারিশ সরকার মেনে চলবে বলে
জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তিনি বলেন, আপাতত সুন্দরবনের পাশে বড় ধরনের শিল্প
অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। তবে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ
প্রকল্পের কাজ বন্ধ হচ্ছে না, চলবে।
গতকাল রোববার বিদ্যুৎ ভবনে আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে তৌফিক-ই-ইলাহী এ কথা বলেন। পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরে শুরু হওয়া জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৪১তম সভা নিয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে সুন্দরবনে কী ধরনের অবকাঠামো করা যাবে, সে বিষয়ে একটি কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রতিবেদন (এসইএ) তৈরির ব্যাপারে সরকার ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রতিবেদন ইউনেসকোতে জমা দেওয়া হবে।
২০১৮ সালের আগে সুন্দরবনের পাশে কোনো ধরনের ভারী অবকাঠামো ও শিল্প স্থাপন না করতে ইউনেসকোর শর্ত প্রসঙ্গে তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, সুন্দরবনের পাশে আর কোনো ভারী শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণে সরকার অনুমোদন দিচ্ছে না। ইউনেসকোর এই সুপারিশ ভবিষ্যতের অবকাঠামোর জন্য বলা হয়েছে। রামপালের কাজ তো আগে থেকেই শুরু হয়েছে এবং এখনো চলছে।
পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও পরিবেশবাদী আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার কিপারস এলায়েন্সের কাউন্সিল কমিটির সদস্য শরীফ জামিল। গতকাল তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনকে এখনই বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ না দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা ইতিবাচক। তবে তার মানে এই নয় যে রামপাল প্রকল্প করার ব্যাপারে ইউনেসকো সম্মতি দিয়েছে। রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে ইউনেসকোর আগের আপত্তি এখনো বহাল আছে। এসইএ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে সরকারকে সুন্দরবনের পাশে কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ না করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে অবশ্যই রামপাল প্রকল্পও পড়ে। ফলে ইউনেসকোর সিদ্ধান্ত যদি সরকার মানে, তাহলে রামপাল প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখতে হবে।
ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় সুন্দরবন নিয়ে মোট ১১টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। চতুর্থ সিদ্ধান্ত হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন ও এর পার্শবর্তী এলাকা, অর্থাৎ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপরে একটি কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (এসইএ) প্রতিবেদন তৈরি করে ইউনেসকোর কাছে জমা দেবে। তারপর ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) তা মূল্যায়ন করবে। এসইএ প্রতিবেদন মূল্যায়ন করার আগ পর্যন্ত সুন্দরবনের পাশে কোনো বড় শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা যাবে না।
১০ নম্বর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার যে এসইএ প্রতিবেদন তৈরি করবে, তাতে রামপাল প্রকল্পের সম্ভাব্য দূষণের বিষয়টি যুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ, ওই প্রকল্পের কারণে বায়ু ও পানির ওপরে কী ধরনের প্রভাব পড়বে এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পশুর নদ থেকে যে পানি উত্তোলন করানো হবে, তার প্রভাবও মূল্যায়ন করতে হবে।
বড় অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করার শর্তে বাংলাদেশ ইউনেসকোতে সম্মত হয়ে এসেছে, তাহলে রামপাল কি কোনো বড় প্রকল্প নয়? সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, ‘কয়লা অনেক কম দামি জ্বালানি। আমাদের মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ অনেক কম। তাই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প আমরা করতেই পারি। আমার মনে একটি প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু সেখানে বলতে পারিনি। তা হচ্ছে, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ তো আর বেশি না। সুন্দরবন আমাদের, এটি কীভাবে রক্ষা করতে হয়, তা আমরা জানি এবং করছি।’
সরকার জনগণের করের টাকা ব্যয় করে লবিস্ট নিয়োগ করে ইউনেসকোকে প্রভাবিত করেছে বলে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে। এ বিষয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, ‘লবিং কী বিষয়, জানি না। তবে সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিবিদেরা দেশের জন্য কাজ করছেন, তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন। এটা তাঁদের দায়িত্ব।’
তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, ‘ইউনেসকো সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে বলেছে। এর জন্য উজানের পানির প্রবাহ বাড়াতে আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাব। পশুর নদ খননের আগে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করতে বলেছে। আমরা তা করব। প্রতিবেশগত মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিতে বলেছে, আমরা তা দিয়েছি।’
৮ নম্বর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের ভেতরে সম্প্রতি যে কয়টি জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এবং তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবসংক্রান্ত তথ্য দিতে হবে।
রামপাল প্রকল্পে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আলট্রা সুপার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে জানিয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বের হওয়া ছাই পুকুরে না রেখে সরাসরি কঠিন করে ফেলা হবে, যা রাস্তা বানানোর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বিশ্ব ঐতিহ্য কমিশনের আলোচনা যে শহরে হচ্ছিল, অর্থাৎ পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরের চারপাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। কিন্তু শহরের চারপাশে সবুজ দিয়ে ভরা, পরিবেশ অনেক ভালো। তিনি বলেন, ‘২১ সদস্যের কমিটি ছিল, এর মধ্যে ১২ জন বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছেন। তুরস্ক আমাদের হয়ে খসড়া সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। ফিনল্যান্ডের মতো দেশ আমাদের পক্ষে ছিল।’
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘রামপাল নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে, এটার অবশ্যই শেষ হওয়া প্রয়োজন। আপনারা ভালোমতো লেখেন এটা নিয়ে। যেন আর কোনো বিতর্ক না হয়।’
ইউনেসকোর সর্বশেষ ১১ নম্বর সিদ্ধান্তে বলা হয়, বাংলাদেশ সুন্দরবন রক্ষায় যে উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছে, সেগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ২০১৮ সালের মধ্যে ইউনেসকোকে জমা দেবে। বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি ২০১৯ সালে মূল্যায়ন করবে।
মিট দ্য প্রেস পরিচালন করেন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আহমেদ কায়কাউস। তিনি বলেন, রামপাল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। প্রথম ইউনিট থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা যাবে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় সরকার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সরকার সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকায় কোনো শিল্পকারখানাকে ছাড়পত্র দিচ্ছে না। এটার সঙ্গে রামপালের কোনো সম্পর্ক নেই।
সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ উপস্থিত ছিলেন।
জানতে
চাইলে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব
আনু মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, রামপাল প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের যে
ক্ষতি হবে, এটা ইউনেসকোর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন ও দেশি-বিদেশি সবার গবেষণায়
প্রমাণিত হয়েছে। এখন সরকার ইউনেসকো বা অন্য কারও দোহাই দিয়ে সুন্দরবন
ধ্বংসকারী এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি করতে চাইছে। এটাই সবচেয়ে বড়
দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। সরকার যদি সত্যিকার অর্থে সুন্দরবন রক্ষা করতে চায়,
তাহলে রামপালসহ সুন্দরবনের আশপাশের সব প্রকল্প বাতিল করতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ