মোঃ মনছুর আলম, তদন্তঃ
৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর গোটা বাংলাদেশের চেহেরাটায় যেন হঠাৎ করে বদলে যায়। ইতিহাস বলছে যা যা করার ছিল, বলতে গেলে তার কিছুই করা হয়নি। অনেকেই ঘা-ঢাকা দিয়েছন, অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, আর অনেকে বাতাস বুঝে ছাতা মেলে দাঁড়িয়েছেন। আমি কাদের কথা বলছি সেটা খোলাসা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ৭৫ এর ১৫ই আগস্টের ঐ ধম বন্ধ করা গোমড় পরিস্থিতির ভিতর থেকেও ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, শেরপুর সহ কয়েকটি অঞ্চলের কিছু মানুষ কেমন করে, কোন সাহসের জোরে রুখে দাঁড়িয়েছিল তখনকার সরকারের বিরুদ্ধে। শুরু করে দিয়েছিল রীতিমত যুদ্ধ। সে কাহিনী আমি, আমরা, দেশের মানুষ খুব কমই জানি। এমনকি সংবাদ মাধ্যমে এব্যাপারে কখনো তেমন কিছু বলতে শুনিনি আমরা।
চারপাশে পাহাড়, একপাশে বাংলাদেশ, আর একপাশে ভারত এক জটিল ভৌগলিক অবস্থান, বলছি দূর্গাপুরের বিরিশিরি'র কথা। ওখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যায় বেশি। যেখানকার মানুষ ১৫ই আগস্টের নারকীয় হত্যাকান্ডের পর প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। গড়ে তুলেছিল প্রতিবাদ যুদ্ধ, আর তাতে অংশ নিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। সে ঘটনার পর কেটে গেছে ৪২ বছর। এত বড় একটি ঘটনা থেকে গেছে আড়ালে, যারা নিজের জীবনকে হাতের মুঠোই করে তখন রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এখনো তাদের ললাটে লেখা দুষ্কৃতকারী!
তারা কারা? তারা হল প্রতিরোধ যুদ্ধা, আর যেটির নাম তারা রেখেছিল "জাতীয় মুক্তি বাহিনী"! আর তারা শুরু করেছিল রাস্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সরকারের চোখে যা ছিল দেশদ্রোহিতার সমান।
যারা প্রাণ হাতে করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই দিন, তাদের সংখ্যা কিন্তু নিতান্তই কম ছিল না। ৭ হাজারের মত সংখ্যা, এই ৭ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস, যারা সব রকম ঝুঁকিকে একপাশে সরিয়ে রেখে হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র, কিংবা ছিনিয়ে নিয়েছিল সরকারী অস্ত্র। আজ এই সরকারের সময়ও তারা অনেকে অনাহারে, অর্ধাহারে, দুখে দুখে মরছেন। বিনা চিকিৎসায় পড়ে আছেন অনেকেই, অনেকেই মারা গেছে চিকিৎসা না পেয়ে। আর অনেকে বয়ে বেড়াচ্ছেন পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে।
ঐ সময় গঠিত প্রতিরোধ যুদ্ধাদের সংগঠন "জাতীয় মুক্তি বাহিনীর বিভিন্ন দলিলপত্র থেকে জানা যায় কাদের সিদ্দিকি'র নেত্রীত্বে দেশের গারো পাহাড় ঘেঁষা ময়মনসিংহ, শেরপুর, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও নেত্রকোনা জেলার সীমান্ত অন্তত ৩০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে নিজেদের একক ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন প্রতিরোধ যুদ্ধারা। সীমান্তবর্তী এলাকা ল্যাংগুড়া, ফুলবাড়ি, বারমারি, বিজয়পুর, হালুয়াঘাটের গুবড়াকুড়া বিডিআর ক্যাম্প দখল করে নেন।
তথ্য বলছে, ১৫ই আগস্টের পর থেকে পরবর্তী ২ বছর তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। সে যুদ্ধে অংশ নেন অন্তত ৭ হাজারের মত বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। যোদ্ধে প্রায় ৫ হাজার আদিবাসী পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আহত হয় ৮০০ এর মত যুদ্ধা। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ২০০ জনের মত। যাদের মধ্যে ১০৪ জনের মত পরিচয় সনাক্ত করা গেছে। তবে তারা কেউ পাইনি শহিদের মর্যাদা। সে সময় অনেকের মৃতদেহ পর্যন্ত খোঁজে পাইনি তাদের স্বজনরা।
১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে যেসব দামাল ছেলেরা সাহস করে প্রতিরোধ যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকই পরে আর ঘরে ফিরতে পারেননি। রাইফেলের গুলি কেড়ে নিয়েছিল অনেকের জীবন। কিন্তু অনেকেরি শেষ চিহ্নটুকু পাওয়া যায়নি।
প্রতিরোধের ঐ সময়ে তারা সবচেয়ে ঝুঁকি নিয়ে যে কাজটি করেছেন, তা হল থানা আক্রমণ। কেবল আক্রমণই নয়, অস্ত্রশস্ত্র লুট করে নেন তারা। এ এক কঠিন কাজ। এমনকি কলমাকান্দা থানার ওসি'কে স্বপরিবারে জিম্মি করে তারা তুলে নিয়ে যান। ঐ আক্রমণের পর ২৪ই জানুয়ারি প্রায় ৩০০ জনকে দুষ্কৃতকারী, দুর্বিত্ত এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আক্ষা দিয়ে মামলা হয় কলমাকান্দা থানায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার অপরাধে, প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার অপরাধে অনেক যুদ্ধা গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে দুষ্কৃতকারের অভিযোগ মাথায় নিয়া ফেরার হয়েছেন। কিন্তু এই অভিযোগে ফাঁসির কাঠগড়ায় যেতে হবে ভাবতেও পারেননি বিশ্বজিত নন্দি। কিন্তু বাস্তবে এমনি এক শ্বাসরোদ্ধকর পরিস্থিতির মুখামুখি হতে হয়েছে বিশ্বজিত নন্দি'কে। তিন-তিনবার ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মাধ্যমের চাপে, মানবাধীকার সংস্থার তৎপরতায় ফাঁসির দণ্ড থেকে রক্ষা পান তিনি।
৭৫ পরবর্তী বিশ্বাসঘাতকতার সময়ে প্রতিকূল পরিবেশে যারা সরকারের বিরুদ্ধে সাহস করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে গড়ে তুলেছিল রীতিমত প্রতিরোধ, তাদের বীরত্বের কথা এই সরকারের সময়ও কেন সামনে এলনা কিংবা অনুচ্চারিত থেকে গেল। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করছি। কোথায় অদৃশ্য ছায়া আড়াল করে রেখেছে পুরু ব্যাপারটিকে। আর তাই মনে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জেগেছে তারা প্রতিবাদকারী নাকি দুষ্কৃতকারী!
সহযোগীতায়ঃ টিম ৩৬০ ডিগ্রি।
0 মন্তব্যসমূহ