বাঁশখালী উপজেলার বাণীগ্রাম রায় পরিবার একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবার। এই পরিবারের জমিদারি ‘বাণীগ্রাম রায় এস্টেট’ নামে পরিচালিত হত। তবে সবকিছুই এখন ইতিহাস। বিশালাকারের জমিদারের ভিটায় বর্তমানে বাড়ির মন্দির, জমিদারের পুরানো বাড়িটি মোটামুটি অক্ষত আছে। মন্দিরে পূজা হয়। বাড়িতে জমিদারের বংশধররা বসবাস করেন। এছাড়া বাড়ির সীমানা দেয়াল এবং দুটি গেটের চিহ্ন পড়ে আছে। পুকুর ঘাটটিও কিছুটা বিধ্বস্ত। বাড়িতে নেই জমিদারের সেই জৌলুস। কিন্তু বাড়ির কাছেই জমিদারের প্রতিষ্ঠিত বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় বাঁশখালী এবং আশপাশের উপজেলার মানুষকে শতাব্দী কাল ধরে আলোকিত করে আসছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে,
সাধনপুর ইউনিয়নের বাণীগ্রাম জমিদার বাড়ির বিশাল ভিটায় জমিদারদের নানা স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সামনে বিশাল একটি পুকুর। বাড়ির ভিতরে প্রবেশদ্বারে সেই আমলের বিশাল গেটের চিহ্ন রয়েছে। গেটের পাশে রয়েছে মন্দির। মন্দিরের ভেতরে রয়েছে শ্বেত পাথরে তৈরি একটি পুরনো মূর্তি। মন্দিরের পুরোহিত যতন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, মূর্তিটির ওজন হবে প্রায় আড়াইশ গ্রাম। তবে প্রতি বছর দুর্গোৎসবের সময় ষষ্ঠীর দিন ধূপ এবং তেল গরম করে মূর্তিটির আকার বড় করা হয়। দেখতে ভাল লাগার জন্যই মূর্তির আকার বড় করা হয়। মূর্তিটির গায়ে প্রায় আট ভরি স্বর্ণালংকার রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মূল্যবান মূর্তিটি চুরি হয়ে যাওয়ার আশংকায় সেটি এখন বাক্সের ভিতর রাখা হয়। মন্দির পেরিয়ে কিছুদুর গেলেই বাড়ির সীমানা দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ এবং গেট। দেয়ালের প্রশস্ততা প্রায় দুই ফুট। গেট পেরিয়ে জমিদারের বসবাসের ঘর। তিন কক্ষবিশিষ্ট এই ঘরের পেছনে বারান্দা এবং সামনে খোলা বারান্দা ছিল। বর্তমানে সামনের বারান্দায় ছাউনি দেয়া হয়েছে। ঘরের কক্ষগুলি বিশালাকারের। দেয়ালও অনেক মোটা। ছাদ টালি। টালির নিচে লোহার মোটা বিম এবং ছোট লোহার পাত দেয়া হয়েছে। জমিদার বাড়ির চারপাশে ঘুরে দেখান বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কে এম সালাহ্উদ্দীন কামাল। তিনি জানান, সেখানে যে ডাকঘরটি আছে সেটি জমিদারের দেয়া জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। তবে পুরনো ভবনটি এখন আর ব্যবহার হয়না। বর্তমানে নতুন ভবনে ডাক বিভাগের কার্যক্রম চলে। তবে রায় পরিবারের জমিদারি শুরু হওয়ার আগে এখানে শিখ ধর্মের লোকের বসবাস ছিল। ১৭০০ সালের দিকে শিখদের একটি উপসানালয় নির্মিত হয়। সেটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। ১৯১৭ সালে বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয় এই মন্দিরের বারান্দায়। পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়। শিখদের সেই মন্দির ঘুরে দেখা গেছে, মন্দিরটি দ্বিতলবিশিষ্ট। সরু সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠার ব্যবস্থা রয়েছে। ওই সিঁড়ি এতই সরু যে একজন অপরজনকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না। নিচতলার দেয়াল পাঁচ হাত অর্থাৎ সাড়ে সাত ফুট চওড়া। তবে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশের দরজাগুলি অনেক নিচু। সেখানে প্রবেশ করতে হলে মাথা নিচু করেই যেতে হয়। মন্দিরের দ্বিতীয় তলা গম্বুজ আকৃতির। গম্বুজটি অষ্টভুজ আকৃতির। গম্বুজের দেয়াল প্রায় তিন ফুট চওড়া। গম্বুজটির চারপাশে খোলা বারান্দা রয়েছে। গম্বুজে প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি বড় এবং দুটি ছোট দরজা। এছাড়া ভিতরে পাঁচটি কোটরি রয়েছে। গম্বুজের ভিতরের কারুকাজ অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। মন্দির নির্মাণে প্রায় দুই ইঞ্চি পুরুত্বের টালির মত ইট ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো এই মন্দিরটি এখন আগাছার দখলে। নানা ধরনের আগাছা মন্দিরটিকে গ্রাস করে ফেলেছে। কে এম সালাহ্উদ্দীন কামাল বলেন, রায় পরিবার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে হাজার হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থী দেশে ও বহির্বিশ্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত আছেন। জমিদার পরিবার তাদের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি এলাকায় শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সংস্কারে ব্যাপক ভুমিকা রাখেন।
বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ও সাধনপুর ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম খোন্দকার মোহাম্মদ ছমিউদ্দীন এক প্রবন্ধে লিখেন প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে জমিদারি প্রথা চালু হয়। রায় এস্টেটের অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন বনমালী মজুমদার। বনমালী মজুমদার দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফিরে বাণীগ্রাম গ্রামকে স্থায়ী বসতি স্থাপনের জন্য নির্ধারণ করেন। সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বর্তমান কক্সবাজার জেলার রামু, উখিয়া ও টেকনাফ পর্যন্ত তাঁদের জমিদারি বিস্তৃত ছিল। কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কের আশেপাশে অনেক জায়গার আরএস জরিপে বাণীগ্রাম রায় পরিবারের ওয়ারিশদের নামোল্লেখ আছে। ১৭৬০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রাম জেলা রেভিনিউ কালেকশনের দায়িত্ব নেওয়া পরবর্তী কক্সবাজারের ঈদগাঁসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ‘বাণীগ্রাম রায় এস্টেট’ এর ‘কাচারী বাড়ি’ ছিল। বর্তমান বাঁশখালী ভূমি অফিস তৎকালীন সময়ে রায় পরিবারের রেভিনিউ অফিস ছিল। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ২২টি পালং/ মৌজায় তাঁদের জমিদারি বিস্তৃত ছিল।
তাঁর ওই নিবন্ধে তিনি আরো বলেন, বাংলার মুঘল শাসক মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে এ দেশে জমিদাররা প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। জনশ্রুতি আছে, মুঘল স¤্রাট শাহজাহানের পুত্র বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজা যখন আরাকানে পলায়ন করেন তখন বাণীগ্রামের জমিদারদের কোন এক পূর্বপুরুষ শাহ্ সুজার দেওয়ান হিসেবে আরকান রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এর আনুমানিক ৬০/৭০ বছর পর সে বংশের কোন এক পুরুষ চট্টগ্রামে আগমন করেন। ফটিকছড়ি ও চন্দনাইশ উপজেলায় কিছুকাল অবস্থানের পর তাঁরা স্থায়ীভাবে বাণীগ্রামে বসবাস শুরু করেন। বাণীগ্রাম রায় পরিবারের পূর্বপুরুষরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বংশধর বলে অনুমিত হয়। অনুমানের যৌক্তিকতা হিসেবে বলা যায়, জমিদার পরিবারের কূলদেবতা দশভূজা মন্দিরের মুর্তিটির আদি অবস্থান ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের তৎকালিন রাজধানী উদয়পুরের চ–ী মায়ের মন্দিরে। ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাসে উল্লেখ আছে, তাঁদের অধিষ্টাত্রী দেবী চ–ীর মুর্তিটি মুসলমান ও মগদের যুদ্ধের সময় অপহরণ বা চুরি হয়ে যায়। বাণীগ্রাম জমিদার পরিবারের মন্দিরে যে অধিষ্টাত্রী দেবী মূর্তিটি রয়েছে তা যে উদয়পুরের চ–ী মায়ের মুর্তি, তা ত্রিপুরার এক প্রবীণ সন্ন্যাসী বাণীগ্রাম এসে শনাক্ত করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
বাণীগ্রামের বাসিন্দা প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হিমাংশু বিমল ভট্টাচার্য্য পূর্বকোণকে জানান, রায় পরিবারের জমিদারি ছিল অনেক বিস্তৃত। সময়ের সাথে সাথে তাদের পদবির পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম দিকে তাদের পদবী ছিল মজুমদা। এই পদবী মোগল আমলের বলে তাঁর ধারণা। তিনি জানান, মোগল আমলে হয়তো রাজস্ব আদায় কিংবা মজুদের সাথে এই পরিবারের সম্পর্ক ছিল। জমিদার পরিবার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই পরিবার তাদের প্রয়োজনীয় কাজের জন্য একেকটি পাড়া সৃষ্টি করেছিল। কাপড় ধোয়ার জন্য ধোপিপাড়া, চুল কাটার জন্য নাপিতপাড়া, বাগানের জন্য মালিপাড়া, লাঠিয়ালদের জন্য জমাদারপাড়া, ব্রাহ্মণপাড়া, কর্মচারীদের জন্য জমিদার বাড়ির পেছনে পিছপাড়া, ঢুলিদের জন্য জেলেপাড়া, পালকি বাহকদের জন্য বেহারাপাড়া। আর জমিদারের আত্মীয়দের পাড়ার নাম হল চৌধুরীপাড়া।
তিনি জানান, জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য দুটি গেট ছিল। গেটের নির্মাণশৈলি এমন ছিল যে, গেটের ভিতরেই দু’ পাশে দুটি কক্ষ ছিল। যেখানে রক্ষীরা থাকতেন। আর গেটের মাঝে চলাচলের পথ ছিল। কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলে রক্ষীদের সামনে দিয়েই যেতে হত। এই পরিবারকে ব্রিটিশরাও সম্মানের চোখে দেখতো। ব্রিটিশরা এখানে আসতো। বর্তমানে জমিদারের বংশধররা যে ভবনে বসবাস করেন সেটি জমিদারির মাঝামাঝি সময়ের পরের দিকের বলে এই প্রবীণ শিক্ষকের ধারণা।
এলাকার আরেক প্রবীণ ব্যক্তি শিক্ষাবিদ প্রদ্যুৎ মিত্র চৌধুরী বলেন, তারা জমিদার পরিবারের আত্মীয়। তিনি জানান, জমিদার বাড়িতে পালকি এবং থানজান রাখার জন্য আলাদা ঘর ছিল। জমিদারের খাজনা আদায়ের জন্য বছরের নির্ধারিত সময়ে পূণ্যাহ হত। এছাড়া যেসব এলাকায় জমিদারি ছিল সেখানে জমিদারের কাছারি ছিল। প্রজারা ওইসব কাছারিতে খাজনা দিত। সেসময় রাস্তাঘাট তেমন ভাল ছিল না। জমিদার পরিবারের সদস্যরা পালকি, থানজান, ঘোড়ার গাড়ির পাশাপাশি জলপথে চলাচল করতেন। শঙ্খনদী হয়ে জলকদর খালের চৌধুরী ঘাট দিয়ে তারা যাতায়াত করতেন।
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, বাণীগ্রাম জমিদার পরিবারের আদি পুরুষ দনুজ দলন দেব। তাঁর পুত্র বনমালী মজুমদার। ধারণা করা যাচ্ছে, দনুজ দলন দেব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আগমন করেন। সে সময় বহিরাগত লোকজন মুঘল স¤্রাটের রাজস্ব বিভাগে চাকুরিতে যোগদান করত। ‘বাণীগ্রাম রায় পরিবার’ বাঁশখালী আগমনের পূর্বে শিখ সম্প্রদায় ও হিন্দু সন্ন্যাসী সম্প্রদায় বাণীগ্রাম আগমন করে অবস্থান করেন। জনশ্রুতি আছে, বাণীগ্রাম রায় পরিবারের তত্ত্বাবধানে গুরু গোবিন্দ সিং এর হাতে লেখা এক কপি শিখ ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থ সাহেব’ রয়েছে।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. আব্দুল করিম এর মতে, বাণীগ্রাম রায় পরিবারের একটি প্রাচীন পূঁথি ছিল। এতে জমিদার পরিবারের পারিবারিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ ছিল। জমিদার বনমালী মজুমদার ত্রিপুরা রাজ্যের একজন উর্ধ্বতন রাজ কর্মচারী ছিলেন। ত্রিপুরা রাজ পরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁদের আদি উপাধি ‘দেব’। পরবর্তীতে ‘মজুমদার’ ও ‘চৌধুরী’ উপাধি গ্রহণের পর সর্বশেষ ব্রিটিশ শাসনামলে তাঁরা ‘রায়’ উপাধি প্রাপ্ত হন। ধারণা করা যাচ্ছে, বনমালী মজুমদার অষ্টাদশ শতাব্দির প্রথমদিকের বংশধর ছিলেন। ড. সুণীতি ভূষণ কানুনগো’র ভাষ্যমতে, মুঘল শাসনামলের শেষ দিকে জমিদার বনমালী মজুমদারের এক পুত্র শম্ভু রায় সাতকানিয়া উপজেলার চরম্বা নামক স্থানে বিস্তৃত জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে বসতি স্থাপন করে জমিদারির গোড়াপত্তন করেন।
বাণীগ্রাম রায় পরিবারের বসতির আশেপাশে এখনও কিছু প্রাচীন নিদর্শন রক্ষিত আছে। বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় ছাত্রবাসসহ (শিখ মন্দির) বিভিন্ন স্থাপনায় মধ্যযুগীয় নির্মাণ শৈলীর প্রমাণ পাওয়া যায়। বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠের পূর্বপার্শ্বে ‘কানা ভিটা’ নামক স্থানে বর্তমানে ১০/ ১২টি পরিবার বসবাস করে। এলাকায় গল্পের আকারে শোনা যায়, আরকান রাজ্যের ছোট–ছোট রাজাদের বংশধরদের কেউ এখানে বসবাস করত। বসবাসকারী একজনের একটি চোখ অন্ধ ছিল বলে তাঁকে ‘কানা রাজা’ বলা হত। তাঁর নামানুসারে এ ‘কানা ভিটা’।
দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও বর্তমান কক্সবাজার জেলায় মগ দস্যুদের হামলার প্রতিকার চেয়ে ঈদগাঁ’র জনৈক কালীচরণ তৎকালীন চট্টগ্রামের ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে একটি চিঠি লিখেন। যা চট্টগ্রাম গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে বলে জানা যায়। ওই কালীচরণ বাণীগ্রাম রায় পরিবারের বংশধর ছিলেন বলে অনুমিত। কথিত আছে, বাণীগ্রাম কালীচরণ পুকুর নামে বড় পুকুরটি তাঁর নামানুসারে হয়েছে। ‘বাণীগ্রাম রায় পরিবার’ তৎকালীন সময়ে সরকারকে সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদান করত।
বাণীগ্রাম রায় পরিবারের জমিদাররা শ্রেণিগতভাবে উচ্চ শ্রেণির হওয়াতে তাঁদের জীবনযাপনে আভিজাত্যের ভাব প্রকাশ পেত। তাঁদের জমিদারি ‘কোর্ট অব ওয়ার্ডস্’ এর অধীন থাকায় অনেক সময় জমিদাররা জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করতেন। নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে কোন কোন সময়ে ক্ষমতা প্রয়োগের কথা জানা গেলেও কার্যত জমিদারগণ ছিলেন প্রজাবৎসল। বর্তমান বাণীগ্রাম বাজারকে প্রবীণ লোকজন জমিদার ‘হরিনারায়ণ চৌধুরী বাজার’ বা ‘চৌধুরী বাজার’ বলে অভিহিত করতেন। তৎকালীন সময়ে এ বাজার খুবই প্রসিদ্ধ ছিল এবং দূর–দুরান্ত থেকে লোকজন এ বাজারে আসত। প্রচলিত আছে, বাজারে আসা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পশ্চিম পার্শ্বের পুকুর পাড়ে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ‘বাণীগ্রাম রায় পরিবার’। এ ছাড়া সাধনপুর ইউনিয়নের রাতা–সাধনপুর এবং খানখানাবাদ ইউনিয়নের রায়ছটা সীমানায় অবস্থিত ‘চৌধুরী ঘাট’ একসময় বাণীগ্রাম জমিদার পরিবারের সাম্পানে যাতায়াতের ঘাট হিসাবে ব্যবহৃত হত। রায়ছটা গ্রামের পূর্ব নাম রায় পরিবারের নামানুসারে ‘রায়ের চড়’ বলেও অনুমান করা যায়।
সুত্র :দৈনিক পূর্বকোণ
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে,
সাধনপুর ইউনিয়নের বাণীগ্রাম জমিদার বাড়ির বিশাল ভিটায় জমিদারদের নানা স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সামনে বিশাল একটি পুকুর। বাড়ির ভিতরে প্রবেশদ্বারে সেই আমলের বিশাল গেটের চিহ্ন রয়েছে। গেটের পাশে রয়েছে মন্দির। মন্দিরের ভেতরে রয়েছে শ্বেত পাথরে তৈরি একটি পুরনো মূর্তি। মন্দিরের পুরোহিত যতন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, মূর্তিটির ওজন হবে প্রায় আড়াইশ গ্রাম। তবে প্রতি বছর দুর্গোৎসবের সময় ষষ্ঠীর দিন ধূপ এবং তেল গরম করে মূর্তিটির আকার বড় করা হয়। দেখতে ভাল লাগার জন্যই মূর্তির আকার বড় করা হয়। মূর্তিটির গায়ে প্রায় আট ভরি স্বর্ণালংকার রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মূল্যবান মূর্তিটি চুরি হয়ে যাওয়ার আশংকায় সেটি এখন বাক্সের ভিতর রাখা হয়। মন্দির পেরিয়ে কিছুদুর গেলেই বাড়ির সীমানা দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ এবং গেট। দেয়ালের প্রশস্ততা প্রায় দুই ফুট। গেট পেরিয়ে জমিদারের বসবাসের ঘর। তিন কক্ষবিশিষ্ট এই ঘরের পেছনে বারান্দা এবং সামনে খোলা বারান্দা ছিল। বর্তমানে সামনের বারান্দায় ছাউনি দেয়া হয়েছে। ঘরের কক্ষগুলি বিশালাকারের। দেয়ালও অনেক মোটা। ছাদ টালি। টালির নিচে লোহার মোটা বিম এবং ছোট লোহার পাত দেয়া হয়েছে। জমিদার বাড়ির চারপাশে ঘুরে দেখান বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কে এম সালাহ্উদ্দীন কামাল। তিনি জানান, সেখানে যে ডাকঘরটি আছে সেটি জমিদারের দেয়া জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। তবে পুরনো ভবনটি এখন আর ব্যবহার হয়না। বর্তমানে নতুন ভবনে ডাক বিভাগের কার্যক্রম চলে। তবে রায় পরিবারের জমিদারি শুরু হওয়ার আগে এখানে শিখ ধর্মের লোকের বসবাস ছিল। ১৭০০ সালের দিকে শিখদের একটি উপসানালয় নির্মিত হয়। সেটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। ১৯১৭ সালে বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয় এই মন্দিরের বারান্দায়। পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়। শিখদের সেই মন্দির ঘুরে দেখা গেছে, মন্দিরটি দ্বিতলবিশিষ্ট। সরু সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠার ব্যবস্থা রয়েছে। ওই সিঁড়ি এতই সরু যে একজন অপরজনকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না। নিচতলার দেয়াল পাঁচ হাত অর্থাৎ সাড়ে সাত ফুট চওড়া। তবে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশের দরজাগুলি অনেক নিচু। সেখানে প্রবেশ করতে হলে মাথা নিচু করেই যেতে হয়। মন্দিরের দ্বিতীয় তলা গম্বুজ আকৃতির। গম্বুজটি অষ্টভুজ আকৃতির। গম্বুজের দেয়াল প্রায় তিন ফুট চওড়া। গম্বুজটির চারপাশে খোলা বারান্দা রয়েছে। গম্বুজে প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি বড় এবং দুটি ছোট দরজা। এছাড়া ভিতরে পাঁচটি কোটরি রয়েছে। গম্বুজের ভিতরের কারুকাজ অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। মন্দির নির্মাণে প্রায় দুই ইঞ্চি পুরুত্বের টালির মত ইট ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো এই মন্দিরটি এখন আগাছার দখলে। নানা ধরনের আগাছা মন্দিরটিকে গ্রাস করে ফেলেছে। কে এম সালাহ্উদ্দীন কামাল বলেন, রায় পরিবার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে হাজার হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থী দেশে ও বহির্বিশ্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত আছেন। জমিদার পরিবার তাদের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি এলাকায় শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সংস্কারে ব্যাপক ভুমিকা রাখেন।
বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ও সাধনপুর ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম খোন্দকার মোহাম্মদ ছমিউদ্দীন এক প্রবন্ধে লিখেন প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে জমিদারি প্রথা চালু হয়। রায় এস্টেটের অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন বনমালী মজুমদার। বনমালী মজুমদার দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফিরে বাণীগ্রাম গ্রামকে স্থায়ী বসতি স্থাপনের জন্য নির্ধারণ করেন। সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বর্তমান কক্সবাজার জেলার রামু, উখিয়া ও টেকনাফ পর্যন্ত তাঁদের জমিদারি বিস্তৃত ছিল। কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কের আশেপাশে অনেক জায়গার আরএস জরিপে বাণীগ্রাম রায় পরিবারের ওয়ারিশদের নামোল্লেখ আছে। ১৭৬০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রাম জেলা রেভিনিউ কালেকশনের দায়িত্ব নেওয়া পরবর্তী কক্সবাজারের ঈদগাঁসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ‘বাণীগ্রাম রায় এস্টেট’ এর ‘কাচারী বাড়ি’ ছিল। বর্তমান বাঁশখালী ভূমি অফিস তৎকালীন সময়ে রায় পরিবারের রেভিনিউ অফিস ছিল। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ২২টি পালং/ মৌজায় তাঁদের জমিদারি বিস্তৃত ছিল।
তাঁর ওই নিবন্ধে তিনি আরো বলেন, বাংলার মুঘল শাসক মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে এ দেশে জমিদাররা প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। জনশ্রুতি আছে, মুঘল স¤্রাট শাহজাহানের পুত্র বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজা যখন আরাকানে পলায়ন করেন তখন বাণীগ্রামের জমিদারদের কোন এক পূর্বপুরুষ শাহ্ সুজার দেওয়ান হিসেবে আরকান রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এর আনুমানিক ৬০/৭০ বছর পর সে বংশের কোন এক পুরুষ চট্টগ্রামে আগমন করেন। ফটিকছড়ি ও চন্দনাইশ উপজেলায় কিছুকাল অবস্থানের পর তাঁরা স্থায়ীভাবে বাণীগ্রামে বসবাস শুরু করেন। বাণীগ্রাম রায় পরিবারের পূর্বপুরুষরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বংশধর বলে অনুমিত হয়। অনুমানের যৌক্তিকতা হিসেবে বলা যায়, জমিদার পরিবারের কূলদেবতা দশভূজা মন্দিরের মুর্তিটির আদি অবস্থান ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের তৎকালিন রাজধানী উদয়পুরের চ–ী মায়ের মন্দিরে। ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাসে উল্লেখ আছে, তাঁদের অধিষ্টাত্রী দেবী চ–ীর মুর্তিটি মুসলমান ও মগদের যুদ্ধের সময় অপহরণ বা চুরি হয়ে যায়। বাণীগ্রাম জমিদার পরিবারের মন্দিরে যে অধিষ্টাত্রী দেবী মূর্তিটি রয়েছে তা যে উদয়পুরের চ–ী মায়ের মুর্তি, তা ত্রিপুরার এক প্রবীণ সন্ন্যাসী বাণীগ্রাম এসে শনাক্ত করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
বাণীগ্রামের বাসিন্দা প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হিমাংশু বিমল ভট্টাচার্য্য পূর্বকোণকে জানান, রায় পরিবারের জমিদারি ছিল অনেক বিস্তৃত। সময়ের সাথে সাথে তাদের পদবির পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম দিকে তাদের পদবী ছিল মজুমদা। এই পদবী মোগল আমলের বলে তাঁর ধারণা। তিনি জানান, মোগল আমলে হয়তো রাজস্ব আদায় কিংবা মজুদের সাথে এই পরিবারের সম্পর্ক ছিল। জমিদার পরিবার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই পরিবার তাদের প্রয়োজনীয় কাজের জন্য একেকটি পাড়া সৃষ্টি করেছিল। কাপড় ধোয়ার জন্য ধোপিপাড়া, চুল কাটার জন্য নাপিতপাড়া, বাগানের জন্য মালিপাড়া, লাঠিয়ালদের জন্য জমাদারপাড়া, ব্রাহ্মণপাড়া, কর্মচারীদের জন্য জমিদার বাড়ির পেছনে পিছপাড়া, ঢুলিদের জন্য জেলেপাড়া, পালকি বাহকদের জন্য বেহারাপাড়া। আর জমিদারের আত্মীয়দের পাড়ার নাম হল চৌধুরীপাড়া।
তিনি জানান, জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য দুটি গেট ছিল। গেটের নির্মাণশৈলি এমন ছিল যে, গেটের ভিতরেই দু’ পাশে দুটি কক্ষ ছিল। যেখানে রক্ষীরা থাকতেন। আর গেটের মাঝে চলাচলের পথ ছিল। কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলে রক্ষীদের সামনে দিয়েই যেতে হত। এই পরিবারকে ব্রিটিশরাও সম্মানের চোখে দেখতো। ব্রিটিশরা এখানে আসতো। বর্তমানে জমিদারের বংশধররা যে ভবনে বসবাস করেন সেটি জমিদারির মাঝামাঝি সময়ের পরের দিকের বলে এই প্রবীণ শিক্ষকের ধারণা।
এলাকার আরেক প্রবীণ ব্যক্তি শিক্ষাবিদ প্রদ্যুৎ মিত্র চৌধুরী বলেন, তারা জমিদার পরিবারের আত্মীয়। তিনি জানান, জমিদার বাড়িতে পালকি এবং থানজান রাখার জন্য আলাদা ঘর ছিল। জমিদারের খাজনা আদায়ের জন্য বছরের নির্ধারিত সময়ে পূণ্যাহ হত। এছাড়া যেসব এলাকায় জমিদারি ছিল সেখানে জমিদারের কাছারি ছিল। প্রজারা ওইসব কাছারিতে খাজনা দিত। সেসময় রাস্তাঘাট তেমন ভাল ছিল না। জমিদার পরিবারের সদস্যরা পালকি, থানজান, ঘোড়ার গাড়ির পাশাপাশি জলপথে চলাচল করতেন। শঙ্খনদী হয়ে জলকদর খালের চৌধুরী ঘাট দিয়ে তারা যাতায়াত করতেন।
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, বাণীগ্রাম জমিদার পরিবারের আদি পুরুষ দনুজ দলন দেব। তাঁর পুত্র বনমালী মজুমদার। ধারণা করা যাচ্ছে, দনুজ দলন দেব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আগমন করেন। সে সময় বহিরাগত লোকজন মুঘল স¤্রাটের রাজস্ব বিভাগে চাকুরিতে যোগদান করত। ‘বাণীগ্রাম রায় পরিবার’ বাঁশখালী আগমনের পূর্বে শিখ সম্প্রদায় ও হিন্দু সন্ন্যাসী সম্প্রদায় বাণীগ্রাম আগমন করে অবস্থান করেন। জনশ্রুতি আছে, বাণীগ্রাম রায় পরিবারের তত্ত্বাবধানে গুরু গোবিন্দ সিং এর হাতে লেখা এক কপি শিখ ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থ সাহেব’ রয়েছে।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. আব্দুল করিম এর মতে, বাণীগ্রাম রায় পরিবারের একটি প্রাচীন পূঁথি ছিল। এতে জমিদার পরিবারের পারিবারিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ ছিল। জমিদার বনমালী মজুমদার ত্রিপুরা রাজ্যের একজন উর্ধ্বতন রাজ কর্মচারী ছিলেন। ত্রিপুরা রাজ পরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁদের আদি উপাধি ‘দেব’। পরবর্তীতে ‘মজুমদার’ ও ‘চৌধুরী’ উপাধি গ্রহণের পর সর্বশেষ ব্রিটিশ শাসনামলে তাঁরা ‘রায়’ উপাধি প্রাপ্ত হন। ধারণা করা যাচ্ছে, বনমালী মজুমদার অষ্টাদশ শতাব্দির প্রথমদিকের বংশধর ছিলেন। ড. সুণীতি ভূষণ কানুনগো’র ভাষ্যমতে, মুঘল শাসনামলের শেষ দিকে জমিদার বনমালী মজুমদারের এক পুত্র শম্ভু রায় সাতকানিয়া উপজেলার চরম্বা নামক স্থানে বিস্তৃত জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে বসতি স্থাপন করে জমিদারির গোড়াপত্তন করেন।
বাণীগ্রাম রায় পরিবারের বসতির আশেপাশে এখনও কিছু প্রাচীন নিদর্শন রক্ষিত আছে। বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় ছাত্রবাসসহ (শিখ মন্দির) বিভিন্ন স্থাপনায় মধ্যযুগীয় নির্মাণ শৈলীর প্রমাণ পাওয়া যায়। বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠের পূর্বপার্শ্বে ‘কানা ভিটা’ নামক স্থানে বর্তমানে ১০/ ১২টি পরিবার বসবাস করে। এলাকায় গল্পের আকারে শোনা যায়, আরকান রাজ্যের ছোট–ছোট রাজাদের বংশধরদের কেউ এখানে বসবাস করত। বসবাসকারী একজনের একটি চোখ অন্ধ ছিল বলে তাঁকে ‘কানা রাজা’ বলা হত। তাঁর নামানুসারে এ ‘কানা ভিটা’।
দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও বর্তমান কক্সবাজার জেলায় মগ দস্যুদের হামলার প্রতিকার চেয়ে ঈদগাঁ’র জনৈক কালীচরণ তৎকালীন চট্টগ্রামের ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে একটি চিঠি লিখেন। যা চট্টগ্রাম গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে বলে জানা যায়। ওই কালীচরণ বাণীগ্রাম রায় পরিবারের বংশধর ছিলেন বলে অনুমিত। কথিত আছে, বাণীগ্রাম কালীচরণ পুকুর নামে বড় পুকুরটি তাঁর নামানুসারে হয়েছে। ‘বাণীগ্রাম রায় পরিবার’ তৎকালীন সময়ে সরকারকে সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদান করত।
বাণীগ্রাম রায় পরিবারের জমিদাররা শ্রেণিগতভাবে উচ্চ শ্রেণির হওয়াতে তাঁদের জীবনযাপনে আভিজাত্যের ভাব প্রকাশ পেত। তাঁদের জমিদারি ‘কোর্ট অব ওয়ার্ডস্’ এর অধীন থাকায় অনেক সময় জমিদাররা জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করতেন। নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে কোন কোন সময়ে ক্ষমতা প্রয়োগের কথা জানা গেলেও কার্যত জমিদারগণ ছিলেন প্রজাবৎসল। বর্তমান বাণীগ্রাম বাজারকে প্রবীণ লোকজন জমিদার ‘হরিনারায়ণ চৌধুরী বাজার’ বা ‘চৌধুরী বাজার’ বলে অভিহিত করতেন। তৎকালীন সময়ে এ বাজার খুবই প্রসিদ্ধ ছিল এবং দূর–দুরান্ত থেকে লোকজন এ বাজারে আসত। প্রচলিত আছে, বাজারে আসা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পশ্চিম পার্শ্বের পুকুর পাড়ে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ‘বাণীগ্রাম রায় পরিবার’। এ ছাড়া সাধনপুর ইউনিয়নের রাতা–সাধনপুর এবং খানখানাবাদ ইউনিয়নের রায়ছটা সীমানায় অবস্থিত ‘চৌধুরী ঘাট’ একসময় বাণীগ্রাম জমিদার পরিবারের সাম্পানে যাতায়াতের ঘাট হিসাবে ব্যবহৃত হত। রায়ছটা গ্রামের পূর্ব নাম রায় পরিবারের নামানুসারে ‘রায়ের চড়’ বলেও অনুমান করা যায়।
সুত্র :দৈনিক পূর্বকোণ
0 মন্তব্যসমূহ