চলে গেলেন চট্টগ্রামের অভিভাবক, অবিসংবাদিত নেতা ও চট্টলবীর আলহাজ এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। শুক্রবার ভোররাত ৪ টায় নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একইসাথে নিভে গেল চট্টগ্রামের বাতি। মৃত্যুর খবর পেয়ে হাজার হাজার মানুষ সকালে ছুটে যান মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবনে। নেতাকর্মীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ তাঁর মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনবারের নির্বাচিত মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি দুই পুত্র ও তিন কন্যার জনক। লক্ষ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে লালদিঘি ময়দানে প্রথম দফা বিশাল জানাজা এবং চশমা হিল জামে মসজিদের সামনে দ্বিতীয় দফা জানাজা শেষে চশমা হিল কবরস্থানে পিতার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় এই চির বিপ্লবীকে। তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রী ও সাংসদগণ এবং বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, গত ১১ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে নিজ বাসায় মৃদু হার্ট এটাক এবং কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর মহিউদ্দিন চৌধুরীকে মেহেদিবাগে ম্যাক্স হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরদিন দুপুরে তাঁকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৬ নভেম্বর অসুস্থ মহিউদ্দিনকে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। সিঙ্গাপুরের গ্লিনিগ্যালস হসপিটালে মহিউদ্দিনের এনজিওগ্রাম এবং হার্টের দুটি ব্লকে রিং স্থাপন করা হয়। সেখানে ১১ দিনের চিকিৎসা শেষে ২৬ নভেম্বর রাতে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে দেশে আসেন স্বজনরা। এরপর তাকে আবারো স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১২ ডিসেম্বর তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। দুইদিনের মাথায় ১৪ ডিসেম্বর শারীরিক অবস্থার আবারো অবনতি হলে তাঁকে পুনরায় ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাত ৯ টার দিকে তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৪ সালের পহেলা ডিসেম্বর রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়ির এক সভ্রান্ত পরিবারে । পিতার নাম মরহুম হোসেন আহমদ চৌধুরী আর মাতার নাম মরহুম বেদৌরা বেগম। আট ভাই বোনের মধ্যে মহিউদ্দিন চৌধুরী দ্বিতীয়। তাঁর পিতা চাকুরি করতেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে। পিতার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন চৌধুরী পরাশুনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল, কাজেম আলী ইংলিশ হাই স্কুল, আর প্রবর্তক সংঘ বিদ্যালয়ে। স্কুল জীবনেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। মাধ্যমিক শেষে বাবার আদেশে ভর্তি হয়ে ছিলেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। সেখানের পাঠ না চুকিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রামের অন্যতম বিদ্যাপিঠ চট্টগ্রাম কলেজে। বছর না ঘুরতেই কমার্স কলেজ, আর শেষমেষ সিটি কলেজ। সিটি কলেজেই তাঁর বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরতেই সান্নিধ্যে আসেন জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হন অসংখ্যবার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে আই এস আইয়ের চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমি সদর দপ্তরের কাছে গ্রেপ্তার হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন দীর্ঘ চার মাস। ধারণা করা হয়েছিল পাক বাহিনী তাকে হত্যা করেছে। এরপ্রেক্ষিতে ভারতের একটি মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে শহীদ মহিউদ্দীন চৌধুরীর নামে একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের নামকরণ পর্যন্ত করা হয়। শহীদ ভেবে তাঁর পিতা ছেলের নামে ফাতেহা পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছিলেন। এরিই মাঝে একদিন মানসিক রোগীর নাটক করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে তাঁকে বের করে দেয়া হয়। পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। ছিলেন ভারত–বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন নতুন সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের আর আদরের ছাত্রনেতা ছিলেন মহিউদ্দীন চৌধুরী। যুদ্ধের পর জড়িয়ে পড়েন শ্রমিক লীগের রাজনীতিতে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার পর তৎকালীণ সরকার মহিউদ্দিন চৌধুরী ও মৌলভী সৈয়দকে ধরার জন্য অভিযান চালায়। মৌলভী সৈয়দ ধরা পড়লেও মহিউদ্দিন চৌধুরী ভাগ্যক্রমে পালাতে সক্ষম হন। পরবর্তিতে সামরিক বাহিনৗর নির্যাতনে মারা যান মৌলভী সৈয়দ। মহিউদ্দিন চৌধুরী পালিয়ে ভারতে চলে যান। দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকে ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন তিনি। দেশে এসেই একের পর এক হুলিয়া, সামরিক বাহিনীর হাতে নিষ্পেষণ, নির্যাতন, আর একের পর এক কারাভোগ। এরশাদের শাসনামলে চট্টগ্রামে স্বয়ং জান্তা প্রধানকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে চক্ষশূল হন সরকারের। ফলে আবারও কারাবন্দি। ততদিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নমনি হয়ে উঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতৃত্ব দেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ছাড়াও নেতৃত্ব দিয়েছেন বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও। মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৯৪ সালে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে দ্বিতীয় দফা এবং ২০০৫ সালে তৃতীয় বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন।
সূত্রঃ দৈনিক পূর্বকোণ
0 মন্তব্যসমূহ