চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাশেই গড়ে উঠেছে শতাধিক স মিল। এসব স মিলের অধিকাংশেরই নেই কোনো বৈধ অনুমতিপত্র। স’ মিলগুলোতে মজুদ করা হচ্ছে বন থেকে চুরি করে আনা গাছ। এনিয়ে কথা উঠলে সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তারা নানামুখী দোহাই দিয়ে নীরব থাকেন। ফলে বনদস্যুরা বাধাহীনভাবে নির্বিচারে গাছ কাটছে আর মজুদ করছে। স্থানীয় মহলের অভিযোগ, উপজেলার পুঁইছড়ি ও চাম্বল সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গত ১৫ দিনে অন্তত ১০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ১২২টি স’ মিলে মজুদ করা হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকার চোরাই কাঠ।
চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী বলেন, বনাঞ্চলের গাছ বনদস্যুরা কাটছে না, বনরক্ষকরা কাটাচ্ছে। কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা নিজেদেরকে বনের মালিক মনে করে গাছ বিক্রি করে দিচ্ছে। ঊর্ধ্বতন বন কর্মকর্তারা বাঁশখালীর বন কর্মকর্তাদের কাছ অন্যায় সুবিধাগ্রহণ না করলে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ নির্বিচারে বাধাহীনভাবে কিভাবে কাটা যায়? বাঁশখালীর বনাঞ্চল তো এখন মরুভূমি। এখানে কোনো রকম বদলি ছাড়াই একেকজন বন কর্মকর্তা একটানা ১০/১৫ বছর ধরে চাকরি করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাঁশখালীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১২২টি স’মিলের মধ্যে লাইসেন্স আছে মাত্র ১৮টির। বাকী ১০৪টি স’মিল অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এক শ গজ, দুই শ গজ ব্যবধানে পাহাড়ি এলাকায় স’ মিল বসিয়ে বনখেকোরা বেপরোয়াভাবে গাছ বেচা-কেনার হাট বসিয়েছে। পাশাপাশি বন কর্মকর্তারা মাসোহারা নিয়ে স’মিলগুলোকে অবৈধ গাছ বিক্রয়ের বৈধ লাইসেন্স দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কতিপয় অসাধু বন কর্মকর্তা নিজেরাই দালালদের মাধ্যমে গাছ বিক্রয়ে নেমে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাঁশখালীর বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে লাগামহীনভাবে দিন-রাত গাছ কাটা চলছে। বাঁশখালীর বনাঞ্চল ন্যাড়া হওয়ার পথে। পত্রিকায় গাছ কাটার সংবাদ ছাপা হলে কয়েকদিন গাছ কাটা বন্ধ থাকে। কিছু দিন পর আবার লাগামহীনভাবে শুরু হয়ে যায় গাছ কাটা। প্রতিটি স’ মিল বর্তমানে অবৈধ পাহাড়ি কাঠে বোঝাই। বাঁশখালীর প্রধান সড়ক সংলগ্ন স’মিলগুলোতে সড়কের উপরই রাখা হয়েছে বিশালাকৃতির কাটা গাছ।
বাঁশখালীর জলদি, চাম্বল, বৈলছড়ী, সাধনপুর, পুকুরিয়া, পুঁইছড়ী, নাপোড়া এলাকা ঘুরে স্থানীয় গ্রামবাসী রকিব উদ্দিন, ঝুন্টু দাশ, আব্দুর সোবাহান, ছোটন দাশ, জানে আলম, খোরশেদ মিয়াসহ অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিনই পাহাড়ের গাছ কাটা চলছে। বিরামহীন গাছ কাটায় পাহাড়গুলো ন্যাড়া হয়ে গেছে। এসব পাহাড়ি গাছ বিক্রয় হচ্ছে স্থানীয় স’ মিলগুলোতে। অবৈধভাবে কাটা পাহাড়ি গাছগুলো স’ মিলে ঢুকলে বৈধ হয়ে যায়। বনকর্মকর্তারা স’ মিলগুলোতে বসে খোশ-গল্প করে নিজেরাই গাছ বিক্রয়ে স’ মিল মালিকদের প্রকারান্তরে উদ্বুদ্ধ করেন। স্থানীয় গ্রামবাসী অভিযোগ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, একটানা ১০/১৫ বছর ধরে বেশ কয়েকজন বিট কর্মকর্তা বাঁশখালীতে কর্মরত। কয়েকজন বিট কর্মকর্তা প্রকাশ্যে বনাঞ্চলের গাছ বিক্রয়ের সাথে সরাসরি জড়িত। গ্রামবাসী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করলে তদন্তে এসে কাটা গাছ বিক্রয়ের ভাগাভাগির টাকা নিয়ে নীরব থাকে। কারো বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হয় না। বরং গাছ বিক্রয়ে পটু বন কর্মকর্তাদের ২টি/৩টি জায়গার দায়িত্ব দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গাছ বিক্রয় করতে উদ্বুদ্ধ করেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয়রা।
শীলকূপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিন বলেন, বাঁশখালী ইকোপার্কের সেগুন বাগান বিক্রয় করে কতিপয় বন কর্মকর্তা টাকা আত্মসাত্ করলেও কারো বিরুদ্ধে শাস্তি হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স’ মিলের কয়েকজন বৈধ লাইসেন্সধারী অভিযোগ করে বলেন, অবৈধ লাইসেন্সধারী স’ মিল মালিকদের দৌরাত্ম্যে আমরা অসহায়। অবৈধ লাইসেন্সধারীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করলে প্রশাসন বৈধ লাইসেন্সধারীদের বিভিন্ন আইনের ফাঁদে ফেলে হয়রানি করে।
বাঁশখালী উপকূলীয় রেঞ্জের রেঞ্জ সহকারী অলিউল ইসলাম বলেন, বাঁশখালীর মত স মিল কোনো উপজেলায় নেই। উপজেলা উন্নয়ন সভায় এ ব্যাপারে বেশ কয়েকবার আলোচনা হলেও স’ মিলগুলো বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কতিপয় জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি স’ মিল ব্যবসার সাথে জড়িত।
বন বিভাগের বাঁশখালীর জলদী রেঞ্জের রেঞ্জার জহিরুল কবির শাহীন বলেন, গাছকাটা বন্ধ ও অবৈধ স মিল বন্ধের ব্যাপারে আমাদের তত্পরতা নেই, বললে ভুল হবে। তবে লোকবলের অভাবে আমরা আমাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছি না। ইতোমধ্যেই আমরা পুইঁছড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কিছু অবৈধভাবে কাটা গাছ জব্দ করেছি।
সুত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক
0 মন্তব্যসমূহ