জে এম নাঈম হাসান, ভোলাঃ
সময়ের স্রোত নদীর মতো। কালের গর্বে দিন আসে দিন যায়, এরই মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার নানান ধরনের ঐতিহ্য উৎসবগুলো। ঠিক তেমন করে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে ভোলা জেলার ঐতিহ্য বাহারি পিঠা উৎসব। অন্যান্য জেলার মতো ভোলা জেলাও আধুনিকতার ছোঁয়ায় লেগেছে। যার ফলে ঘরে কিংবা মাঠে আগের মতো হচ্ছে না বাহারি পিঠা উৎসব। পিঠা উৎসবের মধ্যে বাঙালী নারীর রুচি, আদর, ভালবাসায় বিজড়িত যে সৌন্দর্য চিনার বিচিত্র রূপ হাতের স্পর্শে ছড়িয়ে রয়েছে তা এখন আর আগের মতো ফুটে উঠতে দেখা যাচ্ছে না ভোলার লোকালয়ে।
বাংলার সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য ভোলা সরকারি স্কুল মাঠে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় বাহারি পিঠা উৎসব। সেখানে হরেক রকমের পিঠা বানিয়ে উপস্থিত হতেন ভোলার বিভিন্ন এলাকার রমনীরা। তাদের দক্ষ হাতের পিঠাগুলো ডালিতে সাজিয়ে রাখা হতো এক একটি স্টলে। আর দর্শনার্থীরা কিনে নিতেন তাদের পছন্দে পিঠাগুলো। এখন আর সেই আগের মতো হরেক রকমের বাহারি পিঠা এবং উপচে পড়া ক্রেতাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভোলা সরকারি স্কুল মাঠে পিঠা উৎসবে। হঠাৎ করে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ উৎসবটা কিভাবে যেন আনন্দ হারাচ্ছে দিন দিন!
চাউলের গুঁড়ার তৈরি পিঠা বাঙালীর প্রাচীন এবং প্রিয় খাদ্য হিসেবে পরিচিত। চাউলের গুঁড়া দিয়ে প্রাচীনকাল থেকে অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে দুই শতাধিক প্রকার পিঠার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন মৌসুমে, পারিবারিক-সামাজিক অনুষ্ঠানে পালা-পার্বণে পিঠা তৈরি করা হতো। এর মধ্যে নকশী করা অনেক পিঠাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আবার অনেক পিঠাও বিলুপ্তের পথে। তবে শীতের মজাদার পিঠাগুলোর মধ্যে ভাপা, পাটিসাপটা, পাকন, পুলি, মিঠা, ক্ষীরপুলি, নারকেলপুলি, আনারকলি, দুধসাগর এবং চিতই প্রভৃতি এখনও ঠিকে রয়েছে।
আগের দিনে আমণ ধানের নতুন চাল দিয়ে পিঠা তৈরির ধুম পড়ত ভোলার বিভিন্ন অঞ্চলে। সঙ্গে থাকত খেজুরের রস। পিঠার উৎসবে মুখরিত হতো ভোলার প্রতিটি গ্রাম। শীতের সকালে বাড়ির ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ভিড় জমাত চুলার চারপাশে। পিঠা উৎসবকে ঘিরে গ্রামে গোল্লাছুট, হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, ষাঁড় লড়াই ইত্যাদি নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। সন্ধ্যা নেমে এলেই সারা দিনের ক্লান্তি অবসানে বাড়ির উঠানে বসে বাড়ির সবাই গল্প করত। পিঠা খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হতো ঝি-জামাইকে। হালকা শীতের ভোরে জমে উঠত রকমারি পিঠার নাস্তা। কোথায় গেল সেই পিঠা উৎসব? এখন শিশুদের কাছে পিঠা উৎসব মানে বড়দের মুখে শোনা কিছু স্মৃতিকথা।
আগের দিনে দেখা যেত পাড়ায়-মহল্লায় ছোট-বড় সকলেই পিঠা খাওয়ার আনন্দে মেতে উঠত। কিন্তু এখন তা আর চোখে পড়ে না। কর্মচাঞ্চল্য ব্যস্তময় জীবনের গর্বে তা এখন বিলুপ্তি প্রায়। দিন যতই আসে, ততই যেন মানুষের পিঠা বানানোর ব্যস্ততা কমে যাচ্ছে। তবে শীতকালে ভোলার শহরে গ্রাম-গঞ্জে কিছু কিছু হাট-বাজারে দেখা মিলে ভাপা পিঠা, চিতল পিঠা বানানোর ব্যস্ততা। তবে বাহারি রকমের পিঠা তৈরির উৎসাহে আত্মহারা হয়েছে সর্বস্তরের মানুষ।
শীতের আগমনী বার্তায় হত দরিদ্র মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম পন্থা ছিল পিঠা তৈরি। এ পিঠা বিক্রিয় অর্জিত অর্থের মাধ্যমে চলতো তাদের সংসার। তীব্র কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে ভোলা জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে সড়কের পাশে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলতো পিঠা বিক্রিয়। বিভিন্ন শ্রেণীর, পেশার মানুষ এসব পিঠা খাওয়ার জন্য ভিড় করতে দেখা যেত। এসব পিঠা বিক্রিয় কাজে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও যুক্ত হত। এখন সে দৃশ্য তেমন আর বেশি চোখে পড়ে না।
ভোলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে চিতল, দুধ চিতল, পুলি, নকশী, পাটিশাট্টা, ভাপা, চুষি, শিম, পাখন, তেলে, গোটাপিঠা হরেক রকমের পিঠা তৈরিতে নারীদের ব্যস্ত সময় কাটাত। কিন্তু কালের বিবর্তনে কর্মচাঞ্চল্যের কারণে মানুষ এখন বাড়ীতে পিঠা তৈরির উৎসব-আমেজ হারিয়েছে। এতে শীতের বাহারি নকশী করা পিঠা খাওয়ার স্বাদ ও আমেজ হারাচ্ছে এ প্রজন্ম। ভবিষ্যত প্রজন্ম হারাচ্ছে পিঠা তৈরির কৌশল। সে পিঠা বানানোর আমেজ হারিয়ে গেছে অনেক আগে। এখন সবাই পিঠা বাজার থেকে কিনে এনে খায়। এতে কোন আনন্দ-উৎসাহ থাকে না। গৃহিণীদের মধ্যেও আগেকার মতো পিঠা বানানোর উৎসবটা নেই। তাই পিঠা বানানো এখন স্মৃতি হয়ে গেছে ভোলাবাসীর কাছে। এতে করে হরেক রকমের বাহারি পিঠা আমাদের নতুন প্রজন্ম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন!!
0 মন্তব্যসমূহ