কাজী আরিফ আরিয়ান, গাজীপুর প্রতিনিধিঃ
একুশ শতকের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে আমরা কখনই প্রযুক্তিবিমুখ হয়ে এই আধুনিকায়নের বিশ্বে চলাফেরা বা টিকে থাকতে পারব না। তবে মাত্রাতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতা আমাদের মাঝে মাঝে প্রিয়জন থেকে আলাদা করে রাখে। আগের এ্যানালগ প্রজন্মের সময়ে আমাদের পারস্পরিক পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন যতটা দৃঢ় ছিল, আজকের ডিজিটাল আধুনিকতার সময়ে বন্ধনের ক্ষেত্রে এর বিপরীত অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। সময়ের কালস্রোতে আজ আমাদের প্রজন্ম কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। প্রজন্মের এই ডিজিটাল যুগে সব দিকে ভারসাম্য বজায় রাখাটাই মনে করি একটা বড় সামাজিক ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। নবপ্রজন্মকে মাকড়সার জালের মতো চতুর্দিকে ঘিরে রেখেছে এসব আলস্যে ভরা ডিজিটাল যন্ত্র ও প্রযুক্তি।
সেকালে খুব ভোরে ঘুম ভাঙত মুয়াজ্জিনের মধুর আজানের সুরে অথবা মোরগের কুককুরুকু শব্দে। এখন ঘুম ভাঙ্গে ডিজিটাল এ্যালার্মে। মনে করতেই পারছি না সকালে শেষ কবে কাকের ডাক শুনেছি! ছেলেবেলায় আমার মা’কে দেখতাম আব্বাকে কাঁচাবাজার ও বিভিন্ন দরকারি জিনিসের হাতে লেখা ফর্দ ধরিয়ে দিতেন। আর এখন পরিবারের কাছ থেকে দরকারি সাংসারিক জিনিস কিনতে কখনও পাই ই-মেইলে আবার কখনও টেক্সট মেসেজ। শৈশবে আমাদের নানারকম বায়নার মধ্যে ছিল গ্যাস বেলুন, পুতুল বা খেলনা গাড়ি (রিমোট দিয়ে চালানো গাড়ি আমার শৈশবে চোখেও দেখিনি) আর এখনকার শিশুরা রিমোটচালিত হেলিকপ্টার, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট, আইপ্যাড চায়। খেলে নানা রকম ডিজিটাল ভিডিও গেমস। সত্যিই বিচিত্র এই প্রযুক্তিপ্রীতি!
প্রথম ডিজিটাল প্রজন্ম হিসেবে আমরাই সেই শেষ প্রজন্ম ছেলেবেলায় ছবি তুলতে ক্যামেরা ফিল্ম লাগত এবং সেই ফিল্মে নেগেটিভ নামের এক অদ্ভুত বস্তু তৈরি হতো; সেই নেগেটিভকে অন্ধকার ঘরে নিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার পর পানিতে ভেজানো কাগজে ছবি ফুটে উঠত চমৎকারভাবে। এখনকার মতো হরহামেশাই যে কোনো স্থানে কথায় কথায় ক্লিক ক্লিক করে সেলফি কিম্বা স্টিকফি তোলার কথা তখন কি কেউ কল্পনা করতে পারত?
সেই ছোটবেলায় আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখত ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ আর ‘আরব্যরজনীর গল্প’ আর এখনকার প্রজন্মের কাছে ডরেমন, বেন-১০, টম এ্যান্ড জেরি কিম্বা কম্পিউটার কার্টুন আর গেমস অনেক বেশি মজার, থ্রিলিং আর অনেক বেশি বিনোদনের খোরাক। এই দায় আমাদের, নাকি প্রযুক্তির? আমরাই ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি খেলার মাঠ। আমরাই ওর মেধায়-মননে যান্ত্রিকতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছি। আমরাই শিখিয়েছি বই পড়ার চেয়ে টিভি দেখায় অনেক বেশি বিনোদন।
এবার কথা বলা যাক খাবার প্রসঙ্গে। আমরা শৈশবে স্কুলে টিফিন খেতাম ৫ টাকায় একটা সিঙ্গাড়া অথবা ১টা পুরি। বাড়ির কাছের মোড়ের দোকানে ১ টাকায় পাওয়া যেত ১০টা সুপার বিস্কিট (আকারে এখনকার যে কোন প্রমাণ সাইজের বিস্কিটের সমান)। আমরা বাদাম কিনতাম ১ টাকায় এক ঠোঙ্গা, এখনকার প্রজন্ম কি এমনটা কল্পনা করতে পারে? আইসক্রিম বলতে চিনতাম পেতলের ঘণ্টা বাজিয়ে ঠুন ঠুন শব্দ আর টিনের চোঙ্গায় ফুঁ দিয়ে ফেরি করা ‘সুপার মালাই’। মজা করে খেতাম স্যাকারিনের গন্ধওয়ালা আট আনার মালাই। এখন তো অনেক দোকানে ২০ টাকার নিচে আইসক্রিমই হয়না! আবার এখন তো খাবার মানেই পিজা, গ্রিল, হটডগ, চিকেন ফ্রাই,সাসিøক অথবা বার্গার; এসব ছাড়া যেন বাচ্চা-বুড়োদের যেন মনই ভরে না। তবে আমার কাছে ফাস্টফুডকে আসলে জাঙ্কফুড বলা উচিত।
তবে বলতে দ্বিধা নেই যে, আমরা যারা এ্যানালগ যুগ থেকে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি, তারা অনেকেই ভারসাম্যহীন জীবনযাপন করছি। প্রযুক্তিকে জীবনের কতটুকু অংশ দখল করতে দেয়া উচিত, তা বোধ করি ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমদের সকল অনুভূতি যেন এখন ফ্রেমবন্দী হয়ে পড়েছে চ্যাটের চারকোণা বাক্সে। অনলাইনে আর যাই হোক, অনুভূতির সঠিক প্রকাশ হয় না। ফলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকেই যায়। সেই সঙ্গে ক্ষীণ হয় বন্ধনের গাঢ়ত্ব। আর বর্তমানে ফেসবুক যেন জীবনের অধিকাংশ স্থান দখল করে আছে। এখনকার সময়ের প্রজন্ম যখন-তখন, যেখানে-সেখানে বা বিভিন্ন আড্ডা-অবসরে চালায় ফেসবুক আর স্ট্যাটাস দেয় ‘ফিলিং পুতুপুতু’। তারা কি জীবনের আসল স্বাদটা পাচ্ছে? বরং প্রতিদিন পরিবারকে সময় দেয়া জীবনকে আরও বেশি অর্থবহ করে। দামী রেস্টুরেন্টে, দামী ল্যাপটপ কিংবা দামী স্মার্টফোন ব্যবহার জরুরী নয়; পরিবারের সকলে মিলে বাসার ছাদেও বনভোজন করা যায়, সেটাও অনেক উপভোগ্য।
আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে অবশ্য আমরা কখনই প্রযুক্তিবিহীন হয়ে জীবনকে সাজাতে পারব না। তবে কিছুটা হলেও আজকের এই অনাগত প্রজন্মকে পারিবারিক বন্ধন, সম্প্রীতি, অনুশাসন, সামাজিক আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতির সঠিক নির্দেশনা দিয়ে ভবিষ্যত যোগ্য একজন দেশ গড়ার কাণ্ডারী করে গড়ে তুলতেই পারি। কারণ প্রজন্ম আমাদের আর আমরাই প্রজন্মকে উপহার দেব সুন্দর আগামীর সপ্নের বাস্তব পৃথিবী।
0 মন্তব্যসমূহ