কক্সবাজারে দুষিত হচ্ছে সাগরের পানি

আব্দুল আলীম নোবেলঃ
কক্সবাজারে প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক হোটেল মোটেল, রেস্তোঁরা, এবং কটেজের বর্জ্যে দুষিত হচ্ছে সাগরের পানি। এতে পানিবাহিত রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্রের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি পানিতে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে পর্যটকের সংখ্যাও কমে আসবে। যার ফলে একদিকে যেমন পর্যটন শিল্প রক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে, তেমনি ক্ষতির মুখে পড়বে ব্যাবসায়ীরা। এ অবস্থায় বেকার হতে পারে পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত কয়েক হাজার শ্রমিক। অভিযোগ রয়েছে, হোটেল মোটেল জোনের প্রায় ১’শ ৮৪ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিপুল সংখ্যক হোটেলের বর্জ্য থেকে সাগর রক্ষায় সরকারিভাবে সেন্ট্রাল "সোয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি)" স্থাপনের দাবি তুলেছেন সচেতন মহল। এদিকে হোটেল মোটেল মালিক পক্ষ থেকে এসটিপি বসানোর উদ্যোগের কথা জানালেও বাস্তবে এর কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায় নি।

তবে দ্রুত সময়ে কক্সবাজারে সেন্ট্রাল  এসটিপি স্থাপনের কথা জানালেন কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কর্ণেল অব: ফোরকান আহমদ।

তিনি জানান, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) এসটিপি স্থাপনের জন্য সম্ভাব্য একটি স্থান নির্ধারণ করেছে। এ সংক্রান্ত একটি সুপারিশ চেয়ে মন্ত্রনালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। পর্যটন শিল্পকে রক্ষা করতে এসটিপি বসানো জরুরী দাবি করে তিনি বলেন, শুধু এসটিপি নয়, কক্সবাজারকে ঘিরে যে মাস্টার প্ল্যান রয়েছে তাও বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে।

জানা যায়, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে কাজ করছে সরকার। ইতিমধ্যে কক্সবাজারকে ঘিরে পর্যটন শিল্প ও দেশের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে কক্সবাজারে ১ লাখ কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায় হচ্ছে। বর্তমানে কক্সবাজার তার নিজের পরিচিতি দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুনাম অর্জন করেছে। প্রতিদিন দেশি বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটে কক্সবাজারে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বিদেশীদের অবস্থান বেশি। পর্যটন শিল্প বিকাশের সাথে সাথে আবাসন সংকট দুর করতে প্রায় হোটেল মোটেল জোন এলাকায় ১’শ ৮৪ টি হোটেল/মোটেল ও কটেজ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু নির্মিত হোটেলের দুটি ছাড়া কোনটিতেই সোয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) বসানো হয়নি। খরচ বাঁচানোর লক্ষে প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ নিজস্ব কোন এসটিপি বসানো হয়নি। অথচ কোন আবাসিক ভবনে তিন শতের অধিক লোক অবস্থান করলে এসটিপি বসানো বাধ্যতামূলক। এ অবস্থায় হোটেল মোটেল মালিক পক্ষ সাগরেই তাদের বর্জ্য ফেলছে। সরকারি বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে বর্জ্য ফেলায় দুষিত হচ্ছে সাগরের পানি। এতো পানিতে স্যালাইনের মাত্র দিন দিন বাড়তে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সচেতন মহল। এছাড়া বর্জ্য ফেলা অব্যাহত থাকলে পানি দুষনের পাশাপাশি দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে চারদিকে। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের যেমন ক্ষতি হতে পারে, তেমনি পর্যটক আসাও কমে আসতে পারে।

পর্যটন শিল্পের সাথে জড়ি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সাগরের পানিতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে সৈকতে কোন পর্যটক বেড়াতে আসবে না। যদি পর্যটক না আসে তবে কয়েক শত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। আর কর্মহীন হয়ে পড়েব হাজার হাজার শ্রমিক। ক্ষতির মুখে পড়বে হোটেল মোটেল মালিক পক্ষও। তাই নিজেদের স্বার্থে দ্রুত এসটিপি বসানো জরুরী। সরকারিভাবে কখন এসটিপি স্থাপন করা হবে সেদিকে না তাকিয়ে নিজেদেরই পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, কক্সবাজার এখন পর্যটন শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এ শিল্পের উপর ভর করে গড়ে উঠেছে কয়েক শত হোটেল মোটেল, কটেজ এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যদি কক্সবাজারে পর্যটকই না আসে তবে এসব হোটেল মোটেল বা ব্যবসার কোন মূল্য নেই। তাই সরকারিভাবে কখন এসটিপি বসানো হবে সেদিকে না তাকিয়ে মালিক পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় নিজেরাই এর ফল ভোগ করবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পর্যটন শিল্প বিকাশের শুরুতে নিজেদের ইচ্ছা মতো গড়ে উঠেছে হোটেল মোটেল। পরিবেশ বা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ছাড়পত্র নেয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানেনি তারা। এমনকি সোয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান কি তাও জানেন না অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক। তবে হোটেল সায়মান এবং রয়েল টিউলিপ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই এসটিপি বাসিয়েছে। অন্যন্য কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন উদ্যোগ দেখা যায় নি। ইতিমধ্যে হোটেল মোটেল জোন এলাকার ১’শ ৮৪ টি প্রতিষ্ঠানকে কয়েক দপা নোটিশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর। তারপরও তাদের নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইফুল আশ্রাব।

তিনি বলেন, কক্সবাজার হোটেল মোটেল জোন এলাকায় ১’শ ৮৪ টি হোটেল মোটেল এবং কটেজ রয়েছে। তাদের প্রত্যেককে নোটিশ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে মাত্র ৪০/৪৫ টি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নোটিশের জবাব দিলেও অন্যন্য প্রতিষ্ঠান জবাব দেয়নি। তবে সম্প্রতি ১২টি প্রতিষ্ঠান পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে। এছাড়া পরিবেশ সম্মত না হওয়ায় ইতিমধ্যে ৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, যেসব হোটেলে তিন’শ লোক অবস্থান করবে সেখানে অবশ্যই এসটিপি বাধ্যতামূলক। কিন্তু হোটেল মোটেল মালিক পক্ষ এসটিপি বসানো দুরের কথা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফিন্সের ছাড়পত্রও নেয়নি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর যখন প্রতিষ্ঠানের জরিপ করতে যাই তখনও তারা তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যার ফলে কাজ করতে গিয়ে আমাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে আমাদের। এরপরও পরিবেশের আইন অমান্য করে তবে প্রতিষ্ঠানের সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থান নেয়া হবে।

এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশ পাওয়ার পর হোটেল/মোটেল মালিক পক্ষ এসটিপি বসানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছেন সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান।

তিনি বলেন, আমরা সোয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান (এসটিপি) বসানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা হবে। তবে সব হোটেল কিংবা মোটেল সাগরে বর্জ্য ফেলছে না বলে দাবি করেছেন। সরকারিভাবে সেন্ট্রাল এসটিপি বসানো হলে তাতে যুক্ত হওয়ার কথা জানান তিনি।

শহরের নুনিয়ার ছড়া এলাকায় এসটিপি বাসানোর জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ