আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি’ খ্যাতিমান গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা ও দেশ বরণ্যে সুরকার আলতাফ মাহমুদ এর সুরে এই কালজয়ী গানটি একুশের চেতনায় আমাদের উজ্জীবিত করেছে। আমাদের সাহস, অনুপ্রেরণা উৎসাহ যুগিয়েছে। এই একটি গান এত জনপ্রিয় যে, যাকে এখনো অন্য কোন গান জনপ্রিয়তার দিক থেকে অতিক্রম করে যেতে পারিনি। তাইতো একুশের গান বাংলা ভাষার অহংকার। প্রতি বছর বিনম্র শ্রদ্ধায় পালিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারী। একুশ আমাদের অহংকার, একুশ আমাদের গৌরব।
গানে গানে, সুরে সুরে চেতনায় একুশ ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার প্রতিটি পথে প্রান্তরে। বাঙালির মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে বাঙালির রক্তে রাঙা ‘একুশ’ এখন ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ ইউনেস্কোর মূল্যায়নে। সর্বস্তরে আজও বাংলা চালু হয়নি। অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, গবেষণাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখনো ইংরেজির প্রাধান্য বেশি।
১৯৫২ থেকে ২০১৮ আট দশকের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমরা দেখলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। সেই ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে বাঙালি তরুণেরা মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে ঢাকার রাজপথে যে রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, এই ফেব্রুয়ারির সেই রক্তেরই ডাক শুনেছে সমগ্র বাংলাদেশ।
৫২’র শহীদ, তোমাকে সালাম। মাতৃভাষার দাবিতে বাঙালি তরুণদের সেদিনের আত্মবলিদান শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ক্রমেই একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন ও অঙ্গীকার দানা বেঁধেছিল।
সে স্বপ্নই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে।
তাই ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা, মুক্তি, সাম্য, গণতন্ত্র-আধুনিক বাঙালির সব শুভ চেতনার মাস। তার পর আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই দিবসটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও বটে।
মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। সত্য, ন্যায়, শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ় অঙ্গীকারের বার্তা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় এই দিনে। সবার সব পথ এসে মিশে গেছে শহীদ মিনারে। কন্ঠে ছিল সেই চিরচেনা বিষণ্ন সুর। অনুপ্রাণিত ভোরের হাওয়ায় মর্যাদা সুমন্নত রাখতে বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের বুকের রক্ত ঢেলে রাজপথ রাঙিয়ে দেওয়ার দিন অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। দিনটি সারা বিশ্বে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। একুশ মানেই মাথা নত না করা। একুশ মানেই আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিরোধ।
বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের বিষয়টি তাদের রাজনৈতিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের এই দেশের সংখ্যার দিক থেকে ছোট অনেক জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষা রয়েছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি সব সংখ্যালঘু নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয় পরিপুষ্টির সুযোগ অবারিত রাখা অত্যন্ত জরুরি। শুধু আনুষ্ঠানিকতায় মাতৃভাষায় মর্যাদা নয়, সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন ঘটলেই কেবল তার মর্যাদা পায়। শিক্ষাসহ জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমে প্রয়োজন একটি জাতীয় ভাষা পরিকল্পনা। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন কিছু স্থায়ী প্রতিষ্ঠান ও মানুষ, যাঁরা বাংলা ভাষার বিকাশের লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যাবেন।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে শোক, শক্তি ও গৌরবের প্রতীক। ১৯৫২ সালের এ দিনে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, সালামসহ আরও অনেকে। আজ সারাবিশ্বের সকল নাগরিকের সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সকল ভেদাভেদ ভুলে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার শপথ নেই।
একুশের উত্তরাধিকা আমাদের অহংকার, বিষয়টি আমাদেরকে সবার আগে মনে রাখতে হবে। একুশের চেতনা আমাদের সকল আন্দোলন-সংগ্রামের, উৎস। আমাদের সংস্কৃতিতে একুশের ভূমিকা ও গুরুত্ব অতুলনীয়। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে পারলেই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথচলা সহজ ও সুন্দর হবে।
লেখকঃ আতাউল্লাহ আল আজাদ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ নেতা
0 মন্তব্যসমূহ