বাংলাদেশের সর্বত্র ইতিহাস-ঐতিহ্য সংবলিত ও
পর্যটক আকর্ষণ করার মতো বহু নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু একই উপজেলায় একসঙ্গে
অনেক কিছু-এরকম উপজেলা হাতেগোনা কয়েকটি। সেসব উপজেলার মধ্যে অন্যতম
চট্টগ্রামের বাঁশখালী। আরণ্যক সৌন্দর্যমণ্ডিত বাঁশখালীতে কী নেই। পাহাড়,
সাগর, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য, ঝাউবন, মিনি সমুদ্রবন্দর— সবই আছে বাঁশখালীতে।
তারপরও আশানুরূপ পর্যটক টানতে পারে না।
আঁকাবাঁকা
পাহাড়ি সড়ক, চারপাশে ঘন সবুজের সমারোহ, বন্যহাতির বিচরণ, চেনা-অচেনা পাখির
মন-মাতানো কিচিরমিচির শব্দ, দেশের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু, সুউচ্চ টাওয়ার— কী
নেই এখানে। হ্যাঁ, বলছিলাম চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কথা। বহুমুখী আরণ্যক
সৌন্দর্য ও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী পর্যটকদের কাছে টানে। বাংলাদেশে
এমন উপজেলা হাতেগোনা দু’একটি, যেখানে পর্যটক আকর্ষণের অসংখ্য নিদর্শনে
ভরপুর।
পাহাড়, সমুদ্র, নদী, খাল ও
সমতলভূমি বেষ্টিত এ উপজেলায় রয়েছে ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বালুচরসমৃদ্ধ সমুদ্র
সৈকত, ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পাহাড়ি হ্রদ ও প্রাকৃতিক চিড়িয়াখানা সংবলিত নানা
জীববৈচিত্র্যের হৃদয়ছোঁয়া ইকোপার্ক, ৩৬৬২ একরজুড়ে চাঁনপুর-বৈলগাঁও চা
বাগান, সমুদ্র মোহনায় খাটখালী মিনি সমুদ্রবন্দর, সামুদ্রিক মত্স্য আহরণ ও
চিংড়ি চাষের দৃশ্য, পানি থেকে লবণ চাষের দৃশ্য, নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন,
পুরাকীর্তি, ঐতিহাসিক মসজিদ, মন্দির, কেয়াং এবং আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ,
দরবেশ-আউলিয়া ও সাধু-সন্ন্যাসীদের তীর্থভূমি এই বাঁশখালী। এই উপজেলাটি
কক্সবাজার জেলার সঙ্গে লাগোয়া।
অদূর
ভবিষ্যতে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে বাঁশখালীর ওপর দিয়ে কক্সবাজার
দেশ-বিদেশের পর্যটকরা যাতায়াত করবে। সে জন্য চট্টগ্রাম থেকে বাঁশখালী হয়ে
কক্সবাজার মহাসড়কের কাজ প্রায় শেষের পথে।
এদিকে,
শীত মৌসুমকে সামনে রেখে পর্যটন স্পট বাঁশখালী ইকোপার্কে আসেন দর্শনার্থীর ।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের এই পর্যটন স্পটটিতে ২০০৩ সাল থেকে পর্যটকদের আগমন শুরু
হয়।
প্রকৃতির নৈসর্গিক
সৌন্দর্যমন্ডিত উঁচুনিচু পাহাড়, লেকের স্বচ্ছ পানি, বনাঞ্চল ও
বঙ্গোপসাগরের বিতৃত তটরেখা নিয়ে গঠিত হয়েছে বাঁশখালী ইকোপার্ক। বাঁশখালী
উপজেলা সদরের মনছুরিয়া বাজারের ৪ কিলোমিটার পূর্বে এই ইকোপার্কের অবস্থান।
প্রকৃতি এখানে বিছিয়ে দিয়েছে তার সৌন্দর্যের চাদর। কোলাহলমুক্ত পরিবেশে
বণ্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে
ফেলার অপূর্ব স্থান বাঁশখালী ইকোপার্ক।
এটি
যেন প্রকৃতির একখণ্ড স্বর্গ ভূমি। চট্টগ্রামসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলার সাথে এ
পার্কের যাতায়াতের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে না উঠলেও মৌসুমের
শুরুতেই পর্যটকদের ঢল নামে বাঁশখালী ইকোপার্কে। এখানে মিলবে সবুজ ঘনবন আর
নানারকম পশু-পাখি ও বন্য প্রাণীর রোমাঞ্চকর সব দৃশ্য। যেন সে এক রহস্যময়
জগৎ।
পার্কে
এখন শোভা পাচ্ছে ৮৫ প্রজাতির পাখি, ৪৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৫
প্রজাতির সরীসৃপ ও ৭ প্রজাতির উভচর প্রাণী। ১৯৯৭ সালের উদ্ভিদ জরিপ মতে
এখানে আরো পাওয়া যাবে ৩১০ প্রজাতির উদ্ভিদ। এর মধ্যে ১৮ প্রজাতির দীর্ঘ
বৃক্ষ, ১২ প্রজাতির মাঝারি বৃক্ষ, ১৬ প্রজাতির বেতসহ অসংখ্য অর্কিড,
ইপিফাইট ও ঘাস জাতীয় গাছ।
এসব
ছাড়াও পার্কের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রতিদিন ভিড়
জমাচ্ছেন নানা শ্রেণীর পর্যটকরা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ইকোপার্ককে নিয়ে
বিস্তৃত পরিকল্পনা নিলে পর্যটন কেন্দ্রটি জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বশীল হয়ে
উঠতে পারবে।
সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ,
চিরসবুজ বনাঞ্চল ও প্রাণীকূলের এসব অপরূপ সৌন্দর্য পূর্ণমাত্রায় উপভোগ
করার সুবিধার্থে দর্শনার্থীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে দুটি সুউচ্চ
পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। টাওয়ারের চূড়ায় উঠলে অনায়াসে দেখতে পাবেন
কুতুবদিয়া চ্যানেল, বঙ্গোপসাগর ও চুনতি অভয়ারণ্যের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল।
প্রতি
বছরের শীত মৌসুমে এখানে প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় লক্ষ্য করা যায়। একই সাথে
সমুদ্র উপকূলীয় বাহারছড়া ও খানখানবাদ ঝাউবাগানেও পর্যটক আগমন শুরু হয়েছে।
ইকোপার্কের সবুজ বনে পাখির কিচিমিচি শব্দ, পশুপাখির বিচরণ, এলোমেলো অসংখ্য
লেক, আঁকাবাকা রাস্তা, ঝুলন্ত ব্রীজ আর টাওয়ার হতে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে
পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছে।
২০০৮ সালে
পাহাড়ি ঢলের তোড়ে পার্কের বামের ছড়ার বাঁধ ভেঙে বেশ কিছু স্থাপনা ও
হাইড্রোইলেক্ট্রনিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি তছনছ হয়ে যায়। এ সময় ইকোপার্কের বেশ
কিছু স্থাপনা ভেঙে গেলে পর্যটকের সংখ্যা কিছুতা হ্রাস পায়। তবে শীত মৌসুম ও
বিভিন্ন উৎসবে পর্যটকের আনোগোনা থাকে চোখে পড়ার মতো।
পর্যটকরা
জানান, বাঁশখালী এলাকায় পরিবার সদস্যদের নিয়ে বিনোদনের তেমন কোন স্থান
নেই। খোলামেলা পরিবেশের এই ইকোপার্কটি ঘুরে ফিরে সময় কাটানো যায়। শিশুরাও
দোলনায় চড়ে ও ঝুলন্ত সেতু দেখে খুব খুশি। পাখির কিচির-মিচির শব্দে
ভ্রমণপিপাসুদের মন উৎফুল্ল হয়।
প্রতি
বছর ঈদে ও শীত মৌসুমে সমুদ্র সৈকতে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শীতের সময়
অতিথি পাখি আসায় বর্তমানে পর্যটকরা আসা শুরু করেছেন। ফলে আগের চেয়ে উৎসব
মুখর পর্যটন স্পটটি। সুশৃংখলাভাবে পর্যটকরা যাতে ঘুরে বেড়াতে পারে সে জন্য
বন বিভাগ থেকে সব ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
এদিকে
ইকোপার্কে যাওয়ার একমাত্র সড়কটি সরু এবং জ্বরাজীর্ণ হওয়ায় পর্যটক সহ
সাধারণ যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। ইকোপার্কেটিতে নেই উন্নত কোন
খাবর হোটেল।
অবস্থান: বাঁশখালী ইকোপার্কটির অবস্থান উপজেলা সদর জলদি নেমে মনছুরিয়া বাজার থেকে চার কিলোমিটার পূর্বে।
যেভাবে যেতে হবে:
চট্টগ্রাম থেকে এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ। চট্টগ্রাম শহর থেকে
বাঁশখালীর দূরুত্ব মাত্র ৪৫ কিলোমিটার। বাসে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময়
লাগে। সময় লাগবে প্রায় আড়াই ঘণ্টা।
0 মন্তব্যসমূহ