বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ বেড়েছে

বিএন ডেস্কঃ
সারা বিশ্বে বাল্যবিবাহের হার কমলেও বাংলাদেশে বেড়েছে। বাল্যবিবাহের হারে বাংলাদেশের অবস্থান এখন চতুর্থ, তবে সংখ্যার দিক থেকে ভারতের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চেয়ে যে তিনটি দেশে বাল্যবিবাহের হার বেশি, সেগুলো আফ্রিকা মহাদেশের পিছিয়ে পড় দেশ। জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ গতকাল মঙ্গলবার বিশ্বব্যাপী এই সূচি প্রকাশ করেছে।
ইউনিসেফ গতকাল এ নিয়ে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, সাম্প্রতিক বছরে বিভিন্ন দেশে বাল্যবিবাহের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সারা বিশ্বে গত এক দশকে আড়াই কোটি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজনের বিয়ে হয় ১৮ বছর হওয়ার আগেই। কিন্তু এক দশক আগে এই সংখ্যা ছিল প্রতি চারজনে একজন। সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। সেখানে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৫০ শতাংশ থেকে এখন ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে এক দশকে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ের হার ১৫ শতাংশ কমেছে। ইউনিসেফ গতকাল সারা বিশ্বকে এই সুখবর দিলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন।
ইউনিসেফের প্রকাশিত তথ্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনিসেফের পক্ষ থেকে এ ধরনের তথ্য দিয়ে থাকলে তা ঠিক দেয়নি। দেশে বর্তমানে বাল্যবিবাহের হার অনেক কমেছে এবং ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। গ্রহণযোগ্য গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণাতেও বাল্যবিবাহ কমছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাই ইউনিসেফের গ্লোবাল ডেটাবেইসের তথ্যের সঙ্গে আমরা একমত নই।’
কমেছে বিশ্বব্যাপী
সরকারি তথ্যানুযায়ী, ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫২ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হতো। কিন্তু এখন ইউনিসেফ বলছে, বাল্যবিবাহের হার ৫৯ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হচ্ছে নাইজারে, ৭৬ শতাংশ। এরপর আছে সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক (৬৮ শতাংশ) এবং চাঁদ প্রজাতন্ত্র (৬৭) শতাংশ। আর সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হয় ভারতে। সেখানে বছরে ২ কোটি ৬৬ লাখ শিশুর বাল্যবিবাহ হচ্ছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ হচ্ছে ৩৯ লাখ ৩০ হাজার শিশুর।
ইউনিসেফ বলছে, ভারতে বাল্যবিবাহ কমানো সম্ভব হয়েছে নারীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে। তাদের বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বুঝিয়ে সচেতন করা হয়েছে। বাল্যবিবাহের প্রবণতা এখনো সবচেয়ে বেশি আফ্রিকায়। কিন্তু তারপরও ইথিওপিয়ায় এ ধরনের বিয়ের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সাহারা মরুভূমির আশপাশের দেশগুলোতে প্রতি তিনজন নারীর একজনের বাল্যকালেই
এরপর পৃষ্ঠা ৪ কলাম ৪
বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এক দশক আগে এটা ছিল প্রতি পাঁচজনে একজন।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে বিশ্বনেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গাল৴সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচের বাল্যবিবাহকে শূন্য করা, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী নারীর বাল্যবিবাহের হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার নতুন আইন করেছে। সচেতনতা বাড়াতে নানামুখী প্রচারণাও চালাচ্ছে।
ইউনিসেফ বলছে উল্টোটা
২০১৫ সালে ইউনিসেফের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের করা বহুমাত্রিক সূচক নির্ধারণে পরিচালিত গুচ্ছ জরিপ অনুযায়ী, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৫২ শতাংশ নারীর ১৮ বছর পার হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে। আর ১৫ বছর পার হওয়ার আগে বিয়ে হয়েছে ১৮ শতাংশের। সরকারিভাবে ৫২ শতাংশকেই বাল্যবিবাহের সর্বশেষ পরিসংখ্যান হিসাবে ধরা হচ্ছে। তবে গত বছরের ১০ আগস্ট মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ইমেজ প্লাস প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছিলেন, বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ কমে এসেছে।
এ ছাড়া গত বছর ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় করা ‘অ্যাসেসমেন্ট অন কভারেজ অব বেসিক সোশ্যাল সার্ভিসেস ইন বাংলাদেশ (বাংলাদেশে মৌলিক সামাজিক সেবা কাভারেজের মূল্যায়ন)’ শীর্ষক জরিপেও বাল্যবিবাহের হার কমার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
ইউনিসেফের এই তথ্যের সঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫২ শতাংশ বলেই জেনে এসেছি। সরকার, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বিভিন্ন এনজিও, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গঠিত অ্যালায়েন্স, গ্রামে ছেলেমেয়েদের নিয়ে গঠিত বিভিন্ন সংগঠন যেভাবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছে, প্রচার চালাচ্ছে, তাতে করে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি দেশে বাল্যবিবাহ কমেছে। বাল্যবিবাহ বাড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।’
ইউনিসেফ বাংলাদেশের উপপ্রতিনিধি সীমা সেনগুপ্ত গতকাল এক ই-মেইল বার্তায় প্রথম আলোকে বলেন, ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে (জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ) এবং এমআইসিএস (গুচ্ছ জরিপ)—এই দুটি পৃথক জরিপ ছিল। দুই জরিপের নমুনা নির্বাচন পদ্ধতিও ভিন্ন ছিল। তাই দুটি জরিপের ফলাফলে কিছুটা পার্থক্য এসেছে (৫-/‍+), যা গ্রহণযোগ্য। দেশে বর্তমানে বাল্যবিবাহের হার ৫২ থেকে ৫৯ শতাংশের মাঝামাঝি।
পরে সীমা সেনগুপ্ত এ বিষয়ে প্রথম আলোকে আরেকটি বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি বলেন, প্রত্যেক পরিসংখ্যানের নিজস্ব ত্রুটি বিচ্যুতি থাকে। এ ক্ষেত্রে বিচ্যুতির হার কিছুটা বেশি। দেশে বর্তমানে বাল্যবিবাহের হার ৫২ শতাংশ থেকে ৫৯ শতাংশের মধ্যে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গবেষক প্রথম আলোকে বলেন, দুটি জরিপে পার্থক্য হলে তা ৩ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। সে হিসাবে ৫২ থেকে ৫৪ শতাংশ হতে পারে, তা কোনোভাবেই ৫৯ শতাংশ হতে পারে না।
মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জরিপের ভিন্নতার কারণে বাল্যবিবাহের হার ৫২ শতাংশ বা ৫৯ শতাংশ হতেই পারে। ধরেই নিলাম বাল্যবিবাহের হার ৫২ শতাংশ। তাও তো উদ্বেগজনক। দেশে বাল্যবিবাহের প্রকোপ তো অনেক বেশি। পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, অন্যান্য সূচকে যেভাবে অগ্রগতি হয়েছে, সে তুলনায় বাল্যবিবাহ ততটা কমছে না। বাল্যবিবাহের পরিস্থিতি এখনো অনেক নাজুক। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নজর দিতে হবে।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ