বাংলাদেশ, আমাদের মা, মাতৃভূমি। এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। এই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পিছনে এমন কিছু মানুষের বিশেষ অবদান আছে যাদের কথা না বললেই নয়। তাঁরা হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। কিন্তু একজন মহান ব্যক্তি হিমালয় সমান মাথা নিয়ে, রেনেসাঁর মত বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যার দীপ্ত কণ্ঠে সেই রেসকোর্সে স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছিলো তিঁনি হলেন কালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার'ই হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭০ টি বছর পেরিয়ে গেলো।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, বিশ্বের যে ক'টি ছাত্র সংগঠন তাদের নিজ জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তন্মোধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম প্রথম সারিতেই। আমরা জানি, বৃটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কলকাতা ইসলামীয়া কলেজের ছাত্র। তিনি ছিলেন কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক। বৃটিশ উপনিবেশ থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের পর বাঙ্গালীরা নতুন ভাবে শোষনের যাতাকলে পড়ে। যাকে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ''এক শকুনির হাত থেকে অন্য শকুনির হাত বদল মাত্র '' তাই নতুন রাষ্ট্র পাকিস্থানের সরকার প্রথমে আঘাত হানে আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার উপর। শেখ মুজিব তখনই অনুভব করলেন শোষনের কালো দাঁত ভাঙ্গার একমাত্র হাতিয়ার ছাত্র সমাজ। তাই তৎকালিন পাকিস্থান সরকার কতৃক চাপিয়ে দেওয়া উর্দূ ভাষার বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ তৈরির জন্য ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালিন প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতা সম্পম্ন ছাত্র নেতা বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবল্পব্দু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্থান ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু। প্রথমে এর নাম ছিলো 'পাকিস্থান ছাত্রলীগ'।
প্রতিষ্ঠা লগ্নে সংগঠনটির প্রথম আহবায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। ছাত্রলীগ সাংগঠনিক ভাবে কার্যত্রক্রম শুরু করলে এর সভাপতি মনোনিত হন দবিরুল ইসলাম ও সাধারন সম্পাদক মনোনিত হন খালেক নেওয়াজ খান। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের উন্মেষকাল মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন "মহান ভাষা আন্দোলন" এ নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে রক্তাক্ত ও সংগ্রামী যাত্রা পথের সূচনা হয়। এখানে বলতেই হয়; ''রাষ্টভাষা বাংলা চাই' আন্দোলনে যে কজন তেজোদীপ্ত তরুণ ছাত্রনেতা বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে প্রথম সারির নেতা ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র লীগের প্রথম প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ঠাকুরগাঁও এর মুহাম্মদ দবিরুল ইসলাম।
এরপর থেকে সংগঠিত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগ তার এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সফল হয় ।১৯৫৪ সালের স্বৈরাচারী মুসলিমলীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৫৮ সালে আয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪ সালে আয়ুব বিরোধী ও ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন,১৯৬৮ সালের কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান,১১ দফা আন্দোলন ও ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে ছাত্রলীগের গৌরবদীপ্ত ও অবিস্মরণীয় ভূমিকা আজ সর্বজনস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ ৷১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অবদান ছাত্রলীগের ইতিহাসকে দান করেছে অনন্য বৈশিষ্ট ৷বাঙালির সর্ব কালের এই সর্ব শ্রেষ্ট অর্জনকে ছাত্রলীগ সূচিত সংগ্রামের এক শীর্ষ প্রাপ্তি বললে অত্যুক্তি বা ঘাটতি হবে না।জাতির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্রলীগ একটি সংগঠিত প্রতিষ্টান হিসাবে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করতে অত্যন্ত সফলভাবে সমর্থ হয় ৷একটি সংগঠন হিসাবে দুর্জয়ী কাফেলায় পরিণত হয় ৷এজন্য হারাতে হয় অসংখ নেতা-কর্মী ৷সংগঠনের অসংখ শহীদ, অগণিত নেতা-কর্মীর জেল-জুলুম-কারাবরণ, নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ,আর নেতা-কর্মীদের এক নদী রক্তের বিনিময়ে রচিত হয়েছে এক সফল রক্তাক্ত ইতিহাস। স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট -এর পরে প্রথমে খুনি মোশতাক সরকার ও পরে সামরিক স্বৈরাচার খুনি জিয়াউর রহমান এর শাসনামলেও জেল- জুলুম-হুলিয়ার শিকার হয়ে অগণিত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে কারাবরণ,দেশত্যাগ,নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে ৷দেশের মানুষের অধিকার প্রশ্নে আন্দোলন করতে গিয়ে জিয়াউর রহমানের পেটুয়া পুলিশ বাহিনী ও তার সমর্থক সন্ত্রাসীদের আঘাতে-আঘাতে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের রক্তে দেশের রাজপত রঞ্জিত হয়েছে ৷একই অবস্থা ছিল স্বৈরাচার এরশাদের আমলেও ৷তারপরও ছাত্রলীগ ছিল রাজপথের লড়াকু সৈনিক ৷দেশের আপামর জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা এই আন্দোলনে শহীদ হতেও দ্বিধাবোধ করেনি ৷শহীদের রক্ত আর অগণিত নেতা- কর্মীর ত্যাগ-তিতিক্ষার সিঁড়ি বেয়ে ছাত্রলীগ উক্ত আন্দোলনে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে ৷১৯৯৬' র মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও ছাত্রলীগ ছিল অতীতের আলোয় সমুজ্জ্বল৷ছাত্রলীগের ইতিহাস-ত্যাগ স্বীকার ও কারাবরণের ইতিহাস ৷ বিএনপি-জামাত (২০০১-২০০৬) জোট সরকারের আমলেও ছাত্রলীগের অগণিত নেতা কর্মীরা জেল জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
ছাত্রলীগের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলতেই হয়; অতীত গৌরবময় এই সংগঠনের বর্তমানকে করে তুলতে হবে আরো তাৎপর্যপূর্ণ।।ভবিষ্যতের জন্য নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে প্রতিশ্রুতিশীল হিসাবে। যুদ্ধাপরাধী, জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে স্পাত সমান দৃঢ়তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকতে হবে। দুর্যোগের ঘনঘটায় ছাত্রলীগকেই তার ইতিহাস নির্ধারিত অগ্নিদীপ্ত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে যুদ্ধের ময়দানে৷ মেধা,সাহস আর আপোষহীনতার সমন্বয়ে ছাত্রলীগকে গড়ে উঠতে হবে হিমালয় সমান মাথা নিয়ে৷ছাত্রসমাজের অধিকার ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিরসনে অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে ৷ নীতিহীনতা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক এবং ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে যারা ঘাপটি মেরে লেবাছ পরে সংগঠনেরনের ভেতর লুকিয়ে আছে তাদেরকে চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই বিপ্লবী ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে বজায় থাকবে প্রিয় এই সংগঠনে৷
প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্রলীগের যেসব নেতা কর্মী শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার শ্রদ্ধা নিবেদন করি এবং একজন শুভানুধ্যায়ী হিসেবে ছাত্রলীগের সমৃদ্ধি কামনা করি ৷
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখকঃ আতাউল্লাহ আল আজাদ
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ নেতা।
0 মন্তব্যসমূহ