মীর তাওহীদঃ
গাছের মূলে যদি পচন ধরে তাহলে প্রয়োজনীয় উপাদান গুলো পাতা বা শাখাপ্রশাখায় যাবে কিভাবে?আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মুলে পচন ধরেছে।পচনটির নাম হচ্ছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল।এই পচনটি সমূলে উৎপাঠন করে আবার নতুন করে গাছ লাগাতে হবে।শিক্ষা মৌলিক অধিকার।এই মৌলিক অধিকার এতোটাই সহজলভ্য হয়ে গেছে যে এখন প্রতিটি বিল্ডিংয়ে একটি করে স্কুল রয়েছে।যার আঁচ গ্রামে পর্যন্ত চলে গেছে।গ্রামের একটু আল্ট্রা মর্ডান মা বাবারা এখন মনে করে সরকারী প্রাইমেরী স্কুলে পড়ে পিছিয়ে পরা ছেলে মেয়েরা।ভালো ছেলেরা তো কেজি স্কুলে পড়ে।তারা মনে করে তাদের ছেলেরা যথেষ্ট ভালো।তাদের ধারনা আরো পাকাপোক্ত করার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ উদার হস্তে নম্বর বণ্টন করে।
যে এলাকায় থাকি সে এলাকায় সব মিলাই ১০ টির উপরে তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং একটি সরকারী প্রাইমেরী স্কুল আছে।কিছু দিন পর পর সেই সব স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা এসে লিফলেট দিয়ে যায় এবং এক গাদা মুখস্থ বুলি আওড়িয়ে যায় যে ছোট বাচ্চা থাকলে যেনো তাদের স্কুলে ভর্তি করাই।ব্যাচেলর থাকি বললে নিজেরাই বিরক্ত হয়ে মনে মনে গালি দিয়ে চলে যায়।শিক্ষা তো মৌলিক অধিকার।তা ছাড়া এমন কোন মা বাবা নেই যে তার ছেলে মেয়েকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে।তাহলে এভাবে ঘরে ঘরে হারপিক বিক্রি করার মতো এসে ছাত্র খোজা কেন?ওই যে যেখানে দুটি স্কুল থাকা দরকার সেখানে ১০ টি স্কুল।তীব্র প্রতিযোগিতা। এগুলো প্রতিটা এক একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আর ষ্টেশনারী দোকানে সাজিয়ে রাখা খাতা, কলম, স্কেলের মতো শিক্ষাটাও একটি পণ্য যেটি অত্যন্ত সুন্দর করে নার্সারি, কেজি নামের মোড়ক দিয়ে ভোক্তাদের(ছাত্র-ছাত্রীদের) গেলানো হচ্ছে।
একটা ক্লাস ওয়ানের বাচ্চার জন্য বই হচ্ছে বারোটি।যেখানে বিবিএতে পর্যন্ত এক ইয়ারে দশটার বেশী সাব্জেক্ট আমরা পড়িনি।সেখানে ৫ বছরের একটা বাচ্চা পড়বে বারোটি সাবজেক্ট। বাড়তি সাব্জেক্টগুলো পড়াতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা কিংবা কোন সাব্জেক্টগুলো পড়াতে হবে এরকম নির্দেশনা কিন্তু নাই।এক এক স্কুলে এক এক রকম সাব্জেক্ট।তাহলে এতোগুলো সাব্জেক্ট পড়িয়ে তাদের লাভটা কি।ব্যবসা তো এখানেই।ম্যাক্সিমাম সাব্জেক্টগুলোর লেখক প্রকাশক হয় সংশ্লিষ্ট স্কুলের অধ্যক্ষ, পরিচালক বা সভাপতির লিখিত বই।তাও অন্য কোন বই থেকে নকল করে।বই বিক্রির ধান্দা।আর যারা বই লিখে না তারা অন্য কোন অখ্যাত লেখকের বই বিক্রির ইজারা নিয়ে সবাইকে বই কেনা বাধ্যতামূলক করে।এই সব বই গুলো থেকে বলতে গেলে কিছুই শিখেনা।কিছু মুখস্থ বুলি ছাড়া।ছেলে যখন এই সব মুখস্থ বুলি বা কয় লাইনের ইংলিশ গড় গড় করে বলে তখন অভিভাবককের গর্বে বুক ফুলে যায়।ছেলেকে ওই স্কুলে পড়ানো সার্থক মনে করে।
ওই সমস্ত স্কুলে পড়তে হলে বই খাতা সব ওই স্কুল থেকে নিতে হয়।বাইরের খাতা ইউজ করা যায় না।আপনি হয়তো এখানে স্কুলের ব্রান্ডটা দেখছেন। কিন্তু এখানে লুকিয়ে আছে অত্যন্ত লাভজনক একটা বিজনেস আইডিয়া। পনের টাকার খাতার উপর স্কুলের একটা ঢাল লাগিয়ে দিলেই সেই খাতার দাম হয়ে যায় পঞ্চাশ টাকা।প্রতিটা সাব্জেক্টের জন্য দুইটি করে এক বছরের খাতা শুরুতেই নিয়ে ফেলতে হবে লাগুক বা না লাগুক।তারপর ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে লেখানো হয় বেশী।কারণ যতোবেশী লিখবে ততো তাড়াতাড়ি খাতা শেষ হবে।তখন আরো বেশী খাতা বিক্রি করতে পারবে।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরীক্ষা কিংবা দশটা সৃজনশীল দেওয়া বা পঞ্চাশটি এমসিকিউ দিলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না।যারা এই স্তরে উঠে আসবে তারা কতটুকু প্রস্তুত সেটাও একটু ভেবে দেখতে হবে।নামে বেনামে বিল্ডিংয়ে বিল্ডিংয়ে যে স্কুল খুলে ব্যবসা হচ্ছে সেটার লাগাম আগে টেনে ধরতে হবে।
গ্রামে যেখানে সরকারী প্রাথমিক স্কুলগুলো যথেষ্ট ছিলো সেখানে এখন সরকার উলটো টাকা দিলেও তারা মাসে হাজার টাকার বেতন দিয়ে ছেলে মেয়েকে কিন্ডারগার্টেনে পড়ানো অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করে।অথচ এটা যে তাদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের হাতে ললিপপ না দিয়ে সিগারেট তুলে দেওয়ার সামিল তা যদি তারা বুঝতো।
মীর তাওহীদ
বিবিএ, এমবিএ (ফিন্যান্স)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
0 মন্তব্যসমূহ