চট্টগ্রামে ‘গায়েবি’ মামলা

বি,এন ডেস্কঃ
ব্যবসায়িক কাজে ১০ জানুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি শহরে ছিলেন চট্টগ্রাম নগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম। তাঁর বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গত ৬ ফেব্রুয়ারি মামলা করে পুলিশ। এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, ৫ ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া ১১টায় পাঁচলাইশের আরাকান হাউজিং সোসাইটির পেছনে চৌধুরী বিলে গোপন বৈঠক করছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিল আরও ১৮ জন।
সেদিন ঘটনাস্থল থেকে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে এজাহারে উল্লেখ করেছে পুলিশ। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই সাতজনকে গোপন বৈঠক থেকে নয়, তাঁদের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলার ১ নম্বর আসামি বিএনপির সমর্থক মো. মহিউদ্দিন চৌধুরী, তাঁর ভাই মো. তমিজ উদ্দিন চৌধুরী এবং তাঁদের চাচাতো ভাই মো. হেলাল উদ্দিন চৌধুরীকে ৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত আড়াইটায় চট্টগ্রাম নগরের নাজিরপাড়ার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মহিউদ্দিনের ভাই আর ইউ চৌধুরী চট্টগ্রাম নগর বিএনপির আরেক যুগ্ম সম্পাদক। তিনি বলেন, বাড়ি ঘেরাও করে তাঁর তিন ভাইকে সেদিন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। গোপন বৈঠক পুলিশের সাজানো ঘটনা।
এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া মো. রুবেল এখন জামিনে রয়েছেন। তিনি বলেন, সেদিন রাত তিনটায় বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশের অভিযানের ভিডিও ফুটেজ বাসার সিসি ক্যামেরায় সংরক্ষিত আছে।
আর বিএনপি নেতা মঞ্জুরুল আলম বলেন, ভুয়া মামলায় আসামি করায় দেশে ফিরে আদালতে পাসপোর্ট দেখিয়ে জামিন নেন তিনি।
দেশে না থেকেও বিএনপি নেতা গোপন বৈঠকে কীভাবে হাজির ছিলেন-জানতে চাইলে মামলার বাদী পাঁচলাইশ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) গফুর বলেন, নথি না দেখে এ নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে চট্টগ্রামের পাঁচটি থানায় ‘ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠকের’ ঘটনায় পাঁচটি মামলার সন্ধান পাওয়া গেছে। সব কটি মামলায় এজাহারের বর্ণনা অভিন্ন। শুধু জায়গার নাম ভিন্ন। আসামিরা বিএনপির নেতা-কর্মী। প্রতিটি মামলার বাদী সংশ্লিষ্ট থানার এসআই। এজাহারে তাঁরা কথিত ঘটনার বর্ণনা শুরু করেছেন এভাবে, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারলাম যে...।’
পাঁচলাইশ, পতেঙ্গা, খুলশী, ইপিজেড ও বন্দর থানায় ৫-৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ওই পাঁচ মামলা হয়। এতে বিএনপির ১২৪ নেতা-কর্মীকে আসামি করে পুলিশ। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে। এসব মামলাকে ‘গায়েবি’ মামলা বলছেন বিএনপির নেতারা। তাঁরা বলেন, খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণা করার (৮ ফেব্রুয়ারি) আগে হয়রানি করতেই গায়েবি ঘটনা সাজায় পুলিশ।
পাঁচ মামলার বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মাসুদ-উল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিরা সবাই তালিকাভুক্ত। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তাঁরা প্রবলেম (সমস্যা) করেছিলেন।’ গায়েবি ঘটনায় কেন মামলা-এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।’
ইপিজেড থানার মামলাটি হয় গত ৬ ফেব্রুয়ারি। এজাহারে এসআই মো. আশরাফুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ‘ডিউটি থাকাকালীন বেলা পৌনে দুইটায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি যে, ইপিজেড থানাধীন বেপজা স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে কতিপয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মী অবস্থান করে নাশকতার উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠক করেছে।’
এ মামলার ৮ নম্বর আসামি মো. শাহজাহান বলেন, কথিত বৈঠকের সময় তিনি বাসায় ছিলেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন তিনি।
পতেঙ্গা থানায় বিএনপির ২৮ জনের বিরুদ্ধে গত ৭ ফেব্রুয়ারি মামলা করেন এসআই মো. জাকির হোসেন। এজাহারে বলা হয়, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি যে, সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে পতেঙ্গার নিজাম মার্কেটে এলাকাধীন পোড়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন আজমের রিকশা গ্যারেজের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ৫০-৬০ নেতা-কর্মী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জড়ো হয়।’
এ মামলার আসামি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ওরফে নাজমুল হুদা চৌধুরী বলেন, মিথ্যে কাহিনি বানিয়ে পুলিশ মামলায় ফাঁসিয়েছে তাঁকে।
একইভাবে বন্দর থানায় ৬ ফেব্রুয়ারি করা মামলার এজাহারে এসআই মো. মইনুল হাবিব উল্লেখ করেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি যে...।’
এ মামলার আসামি মো. হেলাল হোসেন বলেন, ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় তাঁকে চট্টগ্রাম নগরের ভোলা জেলা সমিতির কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
খুলশী থানায় ৬ ফেব্রুয়ারি ৪৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন এসআই মো. নুর উদ্দীন। এজাহারে বলা হয়, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি যে,...সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে রাত ৮টা ৫০ মিনিটে জালালাবাদ বালুর পাহাড়ে কতিপয় লোক জড়ো হয়।’
এ মামলায় আসামি চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি নূর হোসেন বলেন, কাহিনি সাজিয়েছে পুলিশ। ১৯ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নেন তিনি।
প্রতিটি মামলার এজাহারে মনগড়া ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম। তিনি বলেন, গায়েবি ঘটনায় এসব মামলা করেছে পুলিশ।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অনেক পুলিশ সদস্য সংবিধান ও আইনের চেয়ে সরকারি দলের প্রতি আনুগত্য বেশি দেখিয়ে বেআইনি ও হয়রানিমূলক কাজ করে থাকেন।
সুত্রঃ প্রথম আলো

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ