বিএন ডেস্কঃ
আরো এক মেয়াদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট
নির্বাচিত হয়েছেন রজব তাইয়েব এরদোগান। রোববারের নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয়
পেয়েছেন তিনি। একই দিন অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা
পেয়েছে তার দল। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এরদোগান প্রেসিডেন্সির সাথে
এবার পেতে যাচ্ছেন নির্বাহী ক্ষমতাও।
‘নির্বাচনে জয় নিয়ে যদি আন্তর্জাতিক কোনো
প্রতিযোগিতা থাকত, তবে রজব তাইয়েব এরদোগান বিশ্বের অবিসংবাদিত, অপরাজিত ও
হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরিচিতি পেতেন’। গত বছর তুরস্কের গণভোটে
এরদোগানের বিজয়ের পর বার্তা সংস্থা এএফপি তাদের এক রিপোর্টে এভাবেই
মূল্যায়ন করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্টকে। গত দেড় দশকে ১৪টি নির্বাচনে অংশ
নিয়েছেন এরদোগান। প্রতিটিতেই জয় পেয়েছেন। এর মধ্যে ৬টি পার্লামেন্ট
নির্বাচন, ৩টি গণভোট, ৩টি স্থানীয় নির্বাচন ও দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
শুধু তুরস্ক নয়, বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতেই
সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাদের একজন এরদোগান। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের
মুসলিমদের মাঝেও তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়। এর কারণ এক সময়ের খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলা
তুরস্ককে তিনি পাল্টে দিয়েছেন নিজ হাতে। কামাল আতাতুর্ক দেশটিতে
সেক্যুলারিজমের নামে ইসলাম চর্চার ওপর চরম আঘাত হেনেছিলেন; কিন্তু এরদোগান
মানুষকে দিয়েছেন ধর্ম পালনের অবাধ স্বাধীনতা। পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতেও
মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছেন উচ্চকণ্ঠে। জোরালো ভুমিকা রাখছেন
সকল আন্তর্জাতিক ইস্যুতে।
১৯৫৪ সালে ইস্তাম্বুলের কাশিমপাশায় জন্ম
নেয়া এরদোগান ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বাস্তবমুখী মানসিকতার। বাবা ছিলেন তুর্কি
কোস্টগার্ডের ক্যাপ্টেন। পরিবারে স্বচ্ছলতা থাকলেও তরুণ এরদোগান নিজের খরচ
চালানোর জন্য লেবুর শরবত ও তিলের রুটি বিক্রি করেন। মারমারা
ইউনিভার্সিটিতে ব্যবসায় প্রশাসনে পড়ার সময় ইসলামী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন।
যোগ দেন কমিউনিজম বিরোধী ন্যাশনাল টার্কিস স্টুডেন্ট ইউনিয়নে। ফুটবলও
খেলতেন স্থানীয় একটি নামকরা ক্লাবে। ছাত্রজীবন শেষে যোগ দেন নাজিমউদ্দিন
আরবাকানের ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির যুব সংগঠনে।
১৯৮০ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দলটি
বিলুপ্ত করা হলে আরবাকানের নতুন দল ওয়েলফেয়ার পার্টির সাথে যুক্ত হন। এই দল
থেকেই ১৯৯৪ সালে নির্বাচিত হন ইস্তাম্বুলের মেয়র। বিশৃঙ্খল আর অনুন্নত
ইস্তাম্বুলকে আমূল পাল্টে দেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যে ইউরোপের বড় শহরগুলোর
সাথে পাল্লা দিতে শুরু করে ইস্তাম্বুল। হু হু করে বাড়তে থাকে এরদোগানের
জনপ্রিয়তা। যা তাকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে দেশের সর্বোচ্চ পদে।
১৯৯৮ সালে সেক্যুলার সরকার ওয়েলফেয়ার
পার্টি নিষিদ্ধ করলে বিক্ষোভে অংশ নেন এরদোগান। বিক্ষোভে একটি কবিতা
আবৃত্তির কারণে তার ওপর ক্ষুব্ধ হয় সরকার। কবিতাটি ছিলো, ‘মসজিদ আমাদের
ক্যান্টনমেন্ট, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনার আমাদের বেয়নেট আর বিশ্বাসীরা
আমাদের সৈনিক।’ কয়েক মাস জেল খাটতে হয় তাকে, সেই সাথে পড়তে হয় রাজনৈতিক
নিষেধাজ্ঞার কবলে। কেড়ে নেয়া হয় মেয়র পদও। ২০০১ সালে আবদুল্লাহ গুলসহ
কয়েকজন নেতাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি
সংক্ষেপে যা একে পার্টি নামে পরিচিত। ২০০২ সালে প্রথম পার্লামেন্ট
নির্বাচনে অংশ নিয়েই জয়লাভ করে দলটি।
মূলত এরদোগানের সুনাম আর জাদুকরী নেতৃত্বই
ছিলো দলটির প্রধান পুঁজি। রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে এমপি ও
প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি তিনি। ২০০৩ সালে এক উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে
পার্লামেন্টে আসেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ২০০৭ ও ২০১১ সালের
নির্বাচনেও জয় লাভ করে দলটি। তুরস্কের ইতিহাসে প্রথম নেতা হিসেবে তৃতীয়বার
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় লাভ করে
শপথ নেন তুরস্কের ১২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে তার প্রতি
জনগনের যে আস্থা তৈরি হয়েছিলো তা ক্রমেই বেড়েছে। জনগনের ভালোবাসার প্রতিদান
দিতেও দেরি করেননি এই নেতা। ১৬ বছরের দেশ শাসনে তুরস্ককে তৈরি করেছেন
আধুনিক বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে। একে পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে ঋণে
জর্জরিত ছিলো তুরস্কের অর্থনীতি। কূটনৈতিক ও সামরিকভাবেও নির্ভরশীল ছিলো
পশ্চিমাদের ওপর। শুধু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের(আইএমএফ) কাছেই তুরস্কের
ঋণ ছিলো ২ হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার। ক্রমান্নয়ে সব ঋণ শোধ করে ২০১২
সালে এরদোগান ঘোষণা দেন- ‘এবার আইএমএফ চাইলে তুরস্কের কাছ থেকে ঋণ নিতে
পারে’। ২০০২ সালে যে দেশটির কেন্দ্রিয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিলো ২ হাজার ৬৫০
কোটি ডলার, ২০১১ সালে তাই দাড়িয়েছে ৯ হাজার ২২০ কোটি ডলারে।
তুর্কি নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান অনেকগুণ
উন্নতি হয়েছে তার সময়ে। শুধু অর্থনীতিই নয় প্রতিটি সেক্টরের রীতিমতো
বিপ্লব করেছেন এরদোগান। প্রতিটি প্রদেশে কমপক্ষে একটি করে পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এয়ারপোর্টের সংখ্যা ২৬ থেকে নিয়ে গেছেন
৫০-এ। ধর্ম পালনে যে নিষেধাজ্ঞা ছিলো অতীতে তা ধীরে ধীরে তুলে দিয়েছেন।
অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন ধর্ম পালনের। পাশাপাশি মুসলিম কৃষ্টি-সংস্কৃতি
সংরক্ষণে নিয়েছেন কার্যকরী উদ্যোগ। তবে এসব বিষয়ে কোন তাড়াহুড়ো করেননি
তিনি। তাল মিলিয়ে চলেছেন ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থার সাথেও। তুরস্ক সফরকালে
বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘একজন নেতা কিভাবে একই সাথে ইসলামিক, গণতান্ত্রিক ও
সহিষ্ণু হতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এরদোগান।’ আর এমন রাষ্ট্রনেতার প্রতি
জনগনের আস্থা না থাকার কী কারণ থাকতে পারে!
৬৪ বছর বয়সী এরদোগানের জনপ্রিয়তা কতখানি
তার প্রমাণ বিশ্ববাসী দেখেছে ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই সেনাঅভ্যুত্থান চেষ্টার
সময়। শুধুমাত্র তার একটি একটি ভিডিও বার্তার ডাকে সাড়া দিয়ে ট্যাঙ্ক,
কামানের সামনে রুখে দাড়িয়েছে নিরস্ত্র জনতা। রাষ্ট্রনেতাকে কতখানি
ভালোবাসলে ট্যাঙ্কের পথ রোধ করতে রাস্তায় শুয়ে পড়ে মানুষ!
তবে হঠাৎ করে এই জনপ্রিয়তা আসেনি। সুশাসন,
সমৃদ্ধি আর স্বনির্ভরতার স্বাদ যখন পেতে শুরু করেছে তুর্কিরা- তখনই
এরদোগানের প্রতি বেড়েছে তাদের আস্থা। দীর্ঘদিন পশ্চিমা দেশগুলোকে ধর্ণা
দেয়ার নীতিতে চলেছে তুরস্ক। কিন্তু এই নীতি পাল্টে জাতিকে মাথা তুলে দাড়াতে
শিখিয়েছেন তিনি। ইউরোপ-আমেরিকার চোখে চোখ রেখেও যে কথা বলা যায় সেটি
বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন মানুষকে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রবল আপত্তির মুখেও
গণভোটে জিতে সংবিধান পাল্টে গ্রহণ করেছেন নির্বাহী ক্ষমতা। অর্থনীতি,
কূটনীতির মতো সামরিক শক্তিতেও অনেক এগিয়েছে তুরস্ক। ২০১৫ সালে তুর্কি আকাশ
সীমায় প্রবেশ করার মাত্র ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ধ্বংস করা হয় রাশিয়ার যুদ্ধ
বিমান। যা অসীম সাহসিকাতরই এক নজির।
ধীরে ধীরে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব
রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন এরদোগান। নেতৃত্বহীন মুসলিম বিশ্বকে এগিয়ে
নিতে কাজ করছেন প্রতিনিয়ত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবার
আগে ও সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাড়িয়েছে তুরস্ক।
জেরুসালেম ইস্যুতে ওআইসির চেয়ারম্যান এরদোগান জরুরী সম্মেলন ডেকে পূর্ব
জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী ঘোষণা করেছেন। মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ
করতে চালিয়েছেন ব্যাপক কূটনৈতিক তৎরতা। কাতার সঙ্কটেও মধ্যস্ততার উদ্যোগ
নিয়েছেন। সব কিছু মিলিয়ে তুরস্ক ও নেতৃত্ব দুটো বিষয়কেই বিশ্বের সামনে রোল
মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন এরদোগান।
0 মন্তব্যসমূহ