আরো একবার রজব তাইয়েব এরদোগানের ওপর আস্থা
রাখলেন তুরস্কের ভোটাররা। রোববার অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিকটতম
প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ২২ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন এরদোগান।
একই দিন অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনেও অর্ধেকের বেশি আসন লাভ করেছে
এরদোগানের দল জাস্টিস এন্ড ডেভলপমেন্ট (একে) পার্টি।
২০০৩ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা
এরদোগানকে আরো এক মেয়াদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিলো তুর্কি
ভোটাররা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও সে বছর থেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট
পদে দায়িত্ব পালন করছেন। রোববারের নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত ৯৮
শতাংশ কেন্দ্রের ফলাফলের মধ্যে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন এরদোগান। আর তার
নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুহারেম ইঞ্চ পেয়েছেন ৩০ শতাংশের কিছু বেশি ভোট।
অন্য চার প্রার্থীর সবার প্রাপ্ত ভোট ৮ শতাংশের নিচে। তবে নির্বাচন কমিশনের
এই ঘোষণার অনেক আগেই নিজস্ব সূত্রে প্রান্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বিজয় মিছিল
শুরু করেছে এরদোগানের সমর্থরা।
এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন একটি যুগে
প্রবেশ করল তুরস্ক। দেশটির প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা কার্যকর হবে নতুন
মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে। গত বছর এক গণভোটে তুরস্কের জনগন
প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা অর্জনের পক্ষে রায় দেয়। এর ফলে দেশটির শাসন
ক্ষমতা আরো জোরদার হবে বলে দাবি করছেন এরদোগান ও তার দল একে পার্টি। এই
ক্ষমতা অর্জনের ফলে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে।
দীর্ঘ শাসনামলে তুরস্ককে উত্তরোত্তর
সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার কারণেই এরদোগানকে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়েছে দেশটির
জনগন-এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী
প্রেসিড্টে নির্বাচনে প্রার্থীদের কেউ নূন্যতম পঞ্চাশ শতাংশ ভোট না পেলে,
নির্বাচন গড়ায় দ্বিতীয় দফায়। প্রথম দফায় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থী
প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন দ্বিতীয় দফায়। প্রথম দফা নির্বাচনের পনের দিন পর
অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় দফা নির্বাচন। যদিও ইতোমধ্যেই পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোট
পেয়ে গেছেন দেশটির তুমুল জনপ্রিয় নেতা এরদোগান। তাই দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন
অনুষ্ঠানের আর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
এদিকে একই সাথে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট
নির্বাচনেও বড় ব্যবধানে জয় পেতে যাচ্ছে এরদোগানের দল জাস্টিস এন্ড
ডেভলপমেন্ট (একে) পার্টি। পার্লামন্টে নির্বাচনে এখন পর্যন্ত প্রান্ত
ফলাফলে একে পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট পিপলস এলায়েন্স অর্ধেকের বেশি আসনে
(৩৪২) জয়লাভ করেছে। এর মধ্যে এরদোগানের দল একে পার্টি এককভাবেই পেয়েছে
২৯৩টি আসন। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স পেয়েছে ১৯২টি
আসন।
আল জাজিরা জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই বিজয়
উল্লাস শুরু করেছে একে পার্টি ও এরদোগানের সমর্থকরা। রাজধানী আঙ্কারায় একে
পার্টির সদর দফতরের সামনে হাজির হয়েছে লাখো সমর্থক। তারা বিজয় মিছিল করতে
শুরু করেছেন। ইস্তাম্বুল সহ অন্য অনেক শহরেও আনন্দ উল্লাস শুরু হয়েছে তার
সমর্থকদের মধ্যে।
ইস্তাম্বুলের ভোটার হওয়ার কারণে
নির্বাচনের দিন নিজ শহর ইস্তাম্বুলেই অবস্থান করেছেন এরদোগান। এই নগরীর
মেয়র হিসেবেই জাতীয় রাজনীতির পথে শুরু হয়েছিলো তার যাত্রা। ভোটের ফলাফল
পাওয়ার পর সমর্থকদের উদ্দেশ্যে দেয়া সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় এরদোগান বলেন,
তুরস্কের ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সমৃদ্ধির এই যাত্রা অব্যাহত
রাখতে হবে আমাদের। জনগন আমাদের প্রেসিডেন্সি ও নির্বাহী ক্ষমতা পালনের
দায়িত্ব দিয়েছে। আশাকরি গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেব’।
৬৪ বছর বয়সী এরদোগানের জনপ্রিয়তা কতখানি
তার প্রমাণ বিশ্ববাসী দেখেছে ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই সেনাঅভ্যুত্থান চেষ্টার
সময়। শুধুমাত্র তার একটি একটি ভিডিও বার্তার ডাকে সাড়া দিয়ে ট্যাঙ্ক,
কামানের সামনে রুখে দাড়িয়েছে নিরস্ত্র জনতা। রাষ্ট্রনেতাকে কতখানি
ভালোবাসলে ট্যাঙ্কের পথ রোধ করতে রাস্তায় শুয়ে পড়ে মানুষ!
গত দেড় দশকে ১৪টি নির্বাচনে অংশ নিয়ে
প্রতিটিতে জয়ী হয়েছেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ইস্তাম্বুলের কাশিমপাশায় জন্ম
এরদোগানের। বাবা ছিলেন তুর্কি কোস্টগার্ডের ক্যাপ্টেন। মারমারা
ইউনিভার্সিটিতে ব্যবসায় প্রশাসনে পড়ার সময় ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাথে
যুক্ত হন। যোগ দেন কমিউনিজম বিরোধী ন্যাশনাল টার্কিস স্টুডেন্ট ইউনিয়নে।
ফুটবলও খেলতেন স্থানীয় একটি নামকরা ক্লাবে। ছাত্রজীবন শেষে যোগ দেন
নাজিমউদ্দিন আরবাকানের ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির যুব সংগঠনে। ১৯৮০ সালে
সামরিক অভ্যুত্থানের পর দলটি বিলুপ্ত করা হলে আরবাকানের নতুন দল ওয়েলফেয়ার
পার্টির সাথে যুক্ত হন। এই দল থেকেই ১৯৯৪ সালে নির্বাচিত হন ইস্তাম্বুলের
মেয়র।
১৯৯৮ সালে সেক্যুলার সরকার ওয়েলফেয়ার
পার্টি নিষিদ্ধ করে। কয়েক মাস জেল খাটতে হয় তাকে, সেই সাথে পড়তে হয়
রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন জাস্টিস এন্ড
ডেভেলপমেন্ট পার্টি সংক্ষেপে যা একে পার্টি নামে পরিচিত। ২০০২ সালে প্রথম
পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েই জয়লাভ করে দলটি।
আরো পড়ুন : নির্বাচিত হলে যে ক্ষমতা পাবেন এরদোগান
প্রেসিডেন্ট পদে লড়ছেন এরদোগান। তবে এবার সময় একটু অন্যরকম। ভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত প্রেসিডেন্টের জন্য বেশ কিছু নতুন ক্ষমতা বলবৎ হবে। এ নির্বাচনে এরদোগানের জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। পুনর্বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যে ক্ষমতা পাবেন এরদোগান-
প্রেসিডেন্ট পদে লড়ছেন এরদোগান। তবে এবার সময় একটু অন্যরকম। ভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত প্রেসিডেন্টের জন্য বেশ কিছু নতুন ক্ষমতা বলবৎ হবে। এ নির্বাচনে এরদোগানের জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। পুনর্বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যে ক্ষমতা পাবেন এরদোগান-
১. মন্ত্রী ও ভাইস প্রেসিডেন্টসহ সরকারি
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরাসরি নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা ২. দেশের আইনি ব্যবস্থায়
হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা ৩. জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর
পদ বিলুপ্ত করতে পারবেন তিনি।
নির্বাচনে ছয়জন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী
রয়েছেন। কেউ যদি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পান, তিনিই প্রেসিডেন্ট হবেন। তবে
কেউই যদি ৫০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করতে না পারেন, ৮ জুলাই দ্বিতীয় রাউন্ডের
ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
এবারের তুরস্কের নির্বাচন মূলত দুটি জোটে
বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি পিপলস অ্যালায়েন্স। এখানে আছে এরদোগানের একে
পার্টি, ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি ও গ্রেট ইউনিটি পার্টি। অপরটি
ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স। এছাড়া চারটি দল আছে- শক্তিশালী রিপাবলিকান পিপলস
পার্টি, ফ্যালিসিটি পার্টি, আই পার্টি ও ডেমোক্রেটিক পার্টি। নির্বাচনে
একটি বড় সুবিধা হল, এরদোগান পিপলস অ্যালায়েন্সের একক প্রার্থী। অন্যরা নিজ
নিজ পার্টি থেকে দাঁড়িয়েছেন। রিপাবলিকান পিপলস পার্টির প্রার্থী মুহাররেম
ইন্সে এরদোগানের জন্য হুমকি হতে পারেন।
এই মুহূর্তে এরদোগানের পক্ষে-বিপক্ষে
৫৫-৪৫ শতাংশ। গত নির্বাচনেও তিনি সামান্য ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাই
সঙ্গত কারণেই এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে বোঝা যাবে,
এরদোগান ও তার আন্তর্জাতিক পলিসি থাকবে, না নুতনভাবে অন্য কিছু হবে। অনেক
জেনারেল, পুলিশ অফিসার, সিভিল সার্ভিসের লোকজন ও সাধারণ সরকারি কর্মচারী
দেশ ছেড়েছেন। তাদের শক্তি কতটুকু তাও পরিস্ফুট হবে এই নির্বাচনে, মানুষ
ইসলাম না সেকুলারিজম চায় তাও নির্ধারিত হবে এবার।
দেশের মানুষ কি সত্যিই পরিবর্তন চায়, তার
ভোট হবে এবার। এরদোগান ও তার দল আবার নির্বাচিত হলে তুরস্কে নতুন সিস্টেম
পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে। দেশে ইসলামিকায়ন অভিযান জোরদার হবে। এরদোগান চান,
তার রাজনৈতিক কর্মসূচি সঠিক কিনা, তা জনগণ চূড়ান্তভাবে নিরূপণ করুক। অবশ্য
জনগণ এপ্রিল ২০১৭ সালে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে তার প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন।
এরদোগান ভিশন ২০২৩-এর রূপরেখা দিয়েছেন।
তিনি বিশ্বের সেরা ১০টি আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ দেশের মধ্যে স্থান করার ঘোষণা
দিয়েছেন। এই প্রস্তাবে যোগাযোগ, কৃষি, জ্বালানি ও স্বাস্থ্য খাতে ইতিমধ্যে
প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। আর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিশ্র“ত উন্নয়ন
কর্মসূচি শেষ করতে চান। বিরোধী দল এরূপ বিস্তারিত কোনো উন্নয়ন কর্মসূচি
দিতে পারেনি।সূত্রঃ ডি/এন
0 মন্তব্যসমূহ