বিএন ডেস্কঃ
চলতি বছর মে মাসে জাতিসংঘ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত গোপন চুক্তিতে
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি নেই বলে
জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফিরিয়ে
নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার এবং জাতিসংঘের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। চুক্তির পর
সেই বিষয়ে কোনো পক্ষই প্রকাশ্যে কিছু জানায়নি।
শুক্রবার রয়টার্স দুই পক্ষের মধ্যে করা সমঝোতা স্মারক পর্যবেক্ষণ করে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমনকি এটা অনলাইনেও ফাঁস হয়ে যায়। সমঝোতা স্মারকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা ফিরে গিয়ে রাখাইনে বাস করা অন্যান্য সব গোষ্ঠীর মতোই স্বাধীনতা ভোগ করবে।
শুক্রবার রয়টার্স দুই পক্ষের মধ্যে করা সমঝোতা স্মারক পর্যবেক্ষণ করে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমনকি এটা অনলাইনেও ফাঁস হয়ে যায়। সমঝোতা স্মারকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা ফিরে গিয়ে রাখাইনে বাস করা অন্যান্য সব গোষ্ঠীর মতোই স্বাধীনতা ভোগ করবে।
চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গারা সেখানকার নিয়ম-কানুন মেনে চলবে। এর ফলে
রোহিঙ্গারা রাখাইনের বাইরে চলাফেরা করতে পারবে না। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের
রাখাইন রাজ্যেই নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা করতে হবে। তারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব
পাবে না। অথচ জাতিসংঘের প্রধান লক্ষ্য ছিল, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে
ফেরানো এবং তাদের নাগরিকত্ব প্রদান করা। কিন্তু সেই মূল বিষয়ে চুক্তিতে
কিছু উল্লেখ নেই।
মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ হাটয় এবং সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী উইন মায়াট এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নি।
অন্যদিকে শ্রম, অবিভাসনএবং জনসংখ্যা বিষয়ক পরিচালক বলেন, তিনি এ ব্যাপারে মন্তব্য করার যথাযথ কর্তৃপক্ষ নন।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই চুক্তিটি ব্যর্থ। প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
আরো পড়ুন: দ্বিপাক্ষিক চুক্তি রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান নয় : জাতিসঙ্ঘ
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে মধ্যকার সম্পাদিত সাম্প্রতিক চুক্তিই কেবল রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে স্থায়ী সমাধান নয় বলে মনে করছে জাতিসঙ্ঘ। সংকট নিরসনে ব্যাপকভিত্তিক ও স্থায়ী সমাধান জরুরি বলে মনে করছে সংস্থাটি । যে ব্যবস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে শরনার্থী রোহিঙ্গারা নিরাপদে, স্বইচ্ছায় ও সম্মানজনকভাবে তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে মধ্যকার সম্পাদিত সাম্প্রতিক চুক্তিই কেবল রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে স্থায়ী সমাধান নয় বলে মনে করছে জাতিসঙ্ঘ। সংকট নিরসনে ব্যাপকভিত্তিক ও স্থায়ী সমাধান জরুরি বলে মনে করছে সংস্থাটি । যে ব্যবস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে শরনার্থী রোহিঙ্গারা নিরাপদে, স্বইচ্ছায় ও সম্মানজনকভাবে তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে।
মঙ্গলবার জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের পক্ষে
দেয়া এক বিবৃতিতে এসব কথা জানান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জেফ্রি
ফেল্টম্যান ।
উল্লেখ্য গত ৬ নভেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমার পরিস্থিতির উপর
সর্বসম্মতিক্রমে প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট গ্রহণ করে যেখানে জাতিসঙ্ঘ
মহাসচিবকে স্টেটমেন্ট গ্রহণের ৩০ দিন পর নিরাপত্তা পরিষদে বিবৃতি প্রদানের
অনুরোধ জানানো হয়। সে অনুযায়ী মঙ্গলবার জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের পক্ষে
জাতিসঙ্ঘের রাজনৈতিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জেফ্রি ফেল্টম্যান
মিয়ানমার পরিস্থিতির উপর নিরাপত্তা পরিষদে বিবৃতি প্রদান করলেন।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় মিয়ানমারকে জাতিসংঘের ‘দক্ষতার সম্পদ’ গ্রহন করার
আহ্বান জানান ফেল্টম্যান । এ সময় তিনি জানান ২৫ শে আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত
৬২৬০০০ রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের মূল সমাধান মিয়ানমারে নিহীত।
জননিরাপত্তার জন্য জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা এবং বৈষম্যহীন আইনের শাসন
প্রতিষ্ঠা ব্যাতিরেকে প্রত্যাবাসন ও মীমাংসার নীতি অকার্যকর হতে বাধ্য।
তিনি রাখাইন প্রদেশে ভীতি দুর করতে এবং রোহিঙ্গা কমিউনিটিতে পারস্পরিক
অনাস্থা দূর করতে করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবার প্রতি জোর আরোপ করেন।
নিরাপত্তা পরিষদের আজকের সভায় বক্তৃতা করেন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যৌন
সহিংসতা বিষয়ক জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি মিজ্ প্রমীলা প্যাটেন।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরকালে তিনি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নারী ও
শিশুদের উপর সংঘটিত ভয়াবহ যৌন সহিংসতার যে বাস্তব চিত্র নিজ চোখে দেখে
এসেছেন এবং নির্যাতিত নারী ও শিশুদের যে বক্তব্য শুনেছেন তা এ সভায় তুলে
ধরেন। এসময় তিনি বলেন যা তিনি ৫ থেকে ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সফরকালে দেখে
এসেছেন ‘ তা হৃদয়বিদায়ক ও ভয়াবহ’।
মিজ্ প্যাটেন বলেন, “যারা এখনও যৌন সহিংসতার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন
এবং যারা নিষ্ঠুরতম এই যৌন সহিংসতার দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছেন, তাদের সকলেই
আমাকে বলেছেন, নারকীয়ভাবে মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা ধর্ষণ, গণধর্ষণ,
জনসম্মুখে বিবস্ত্রকরণ এবং সেনাক্যাম্পে আটক রেখে দিনের পর দিন রোহিঙ্গা
নারীদের যৌনদাসত্ব গ্রহণে বাধ্য করার মতো জঘণ্য কাজ গুলো করেছে”।
তিনি সহিংসতার শিকার এমন অনেক নারীর উদাহরণ দেন যাদের কেউ কেউ টানা ৪৫
দিন সেনা ক্যাম্পে ধারাবাহিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেক মেয়েকে তার
স্বামী অথবা পিতার সামনে উলঙ্গ করে ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেক মায়ের সন্তানদের
গ্রামের জলকুপে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। শিশুকে কেড়ে নিয়ে শিশুর সামনে মাকে
ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ধর্ষণ শেষে শিশুটিকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
এমনই সব মর্মস্পর্শী বর্ণনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে মিজ্
প্যাটেন সর্বোচ্চ দ্রুততম সময়ে এই সহিংসতার সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের
সর্বক্ষমতা প্রয়োগের আহ্বান জানান।
আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জেফ্রি ফেল্টম্যান তাঁর বক্তব্যে মিয়ানমার
সঙ্কটের সমাধানে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। সেগুলো হল: ১) রাখাইন স্টেটের
অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশমালাকে ভিত্তি ধরে শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ীভাবে
বাস্তুচ্যুতদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে, ২) প্রত্যাবাসন
হতে হবে উচ্ছেদকৃতদের মুল ভূমিতে বা পছন্দনীয় কাছাকাছি কোন স্থানে, ৩) অবাধ
চলাফেরার স্বাধীনতা থাকতে হবে যাতে তারা জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনগুলো
সংস্থান করতে পারে, ৪) প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে যোগ্যতার মানদন্ড
উদারভিত্তিক হতে হবে, ৫) সকল প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের অভিজ্ঞতাকে
কাজে লাগাতে হবে।
নিরাপত্তা পরিষদের চলতি ডিসেম্বর মাসের সভাপতি জাপানের সভাপতিত্বে
অনুষ্ঠিত এ সভায় পরিষদটির সদস্যদেশ সমূহের বাইরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকেও
বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী
প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, “প্রতিদিন গড়ে
১০০-৪০০ জন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এতে
প্রতীয়মান হয় যে, রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক
পর্যায়ে আসেনি”। তিনি সম্প্রতি উত্তর ও মধ্য রাখাইন প্রদেশের কোন কোন
অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত দ্বি-পাক্ষিক
চুক্তির বিষয়ে রাষ্ট্রদূত আশা প্রকাশ করে বলেন, এ চুক্তির শর্তানুযায়ী
শীঘ্রই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হবে এবং মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী
দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে। তবে তিনি
উল্লেখ করেন এ দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে কেবল প্রত্যাবাসনের কাজটি করা
সম্ভব হতে পারে কিন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক দূর্দশার যে মূল কারণ তা
দূর করতে এতদসংশ্লিষ্ট বহুবিধ বিষয় ও অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো মিয়ানমারকেই
সমাধান করতে হবে এবং এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সহাযোগিতা ও
পর্যবেক্ষণ একান্তভাবে প্রয়োজন, আর তা করতে হবে অসহায় রোহিঙ্গাদের
স্বার্থের কথা বিবেচনা করে।
রাষ্ট্রদূত মাসুদ তাঁর বক্তব্যে রাখাইন প্রদেশের বাস্তুচ্যুত অসহায়
নাগরিকদের মানবিক সহায়তা প্রদান, সহিংসতার নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন তদন্ত ও
বিচার, রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে
একত্রে বসবাস উপযোগী পরিবেশ তৈরির উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ এ সভায় বক্তব্য প্রধান
করেন।
উল্লেখ্য, গত ১৬ নভেম্বর মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর জাতিসংঘ
সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটি উন্মুক্ত ভোটের মাধ্যমে একটি রেজুলেশন গ্রহণ
করে। তৃতীয় কমিটি গৃহীত এই রেজুলেশন অচিরেই সাধারণ পরিষদের প্লেনারিতে
উপস্থাপন করা হবে বলে জাতিসংঘ সূত্রে জানা যায়।
0 মন্তব্যসমূহ