চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর করণীয় নিয়ে ‘নির্দেশিকা’ বানাচ্ছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশন বলছে, অভিযানের সময় বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন। এসব ‘অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানি’ রোধ করতে প্রচলিত একাধিক আইনের আলোকে এ নির্দেশিকা তৈরি হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কমিশনের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে মানবাধিকারকর্মীরা কমিশনের এই উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁদের কথা, কমিশনের উচিত অভিযানে নিহত হওয়ার অন্তত একটি ঘটনা হলেও এর তথ্যানুসন্ধান করা। এখন যে কাজ তারা করছে, তা লোকদেখানো এবং দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা মাত্র।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেছেন, নির্দেশিকা তৈরি নামকাওয়াস্তে একটি লোকদেখানো কাজ ছাড়া আর কিছু না।
মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে গতকাল বুধবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৩২ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। তাঁদের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৬৮ জন এবং র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৩৫ জন নিহত হন। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ১০২। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষ্য, বাকি ২৯ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন দুই পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে।
মাদকবিরোধী অভিযানে এভাবে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একের পর এক নিহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন দেশের মানবাধিকারকর্মীরা। তবে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেই চলেছেন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা। বন্দুকযুদ্ধের বিষয়ে সরকারে তরফের বক্তব্য কমবেশি এমনই যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আত্মরক্ষার্থেই গুলি করে। আর তাতেই প্রাণহানি হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গত ২২ মে এক বিবৃতিতে বলে, তারা এসব বিচারবহির্ভূত হত্যা সমর্থন করে না। তাদের বক্তব্য, মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে । তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার ও দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি লক্ষ রেখে এ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। আর এসব আইনকে একত্র করে একটি নির্দেশিকা বানানোর কাজ করছে কমিশন। এ নিয়ে গত রোববার কমিশনের কার্যালয়ে এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
মানবাধিকার কমিশন মনে করে, এসব অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে কিছু ক্ষেত্রে সচেতন নয়। প্রচলিত নানা আইনে বাহিনীর সদস্যদের আচরণ ও কর্তব্য নির্দিষ্ট আছে। এমন কিছু আইনের মধ্যে আছে ফৌজদারি কার্যবিধি, পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১ এবং পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল। এসব আইন থাকার পরও নির্দেশিকা তৈরি কেন?
কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, ‘আমরা নতুন কোনো আইন করছি না। এসব অভিযানে পুলিশ, র্যাব বা অন্য বাহিনীর সদস্যদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, নির্দেশিকায় সেই বিষয়গুলো থাকবে। শুধু এসব অভিযানের সময় প্রচলিত আইনের কী বিধান আছে বা এসব বাহিনীর সদস্যদের কর্তব্য কী, তা–ই থাকবে নির্দেশিকায়।’
নির্দেশিকা তৈরির সুফল কী হতে পারে? জবাবে রিয়াজুল হক বলেন, ‘আইনগুলোকেই এক জায়গায় ও সহজভাবে তুলে ধরা হবে এই নির্দেশিকায়। আইনের যে প্রক্রিয়া আছে, তা তুলে ধরা বা জানানোই এর লক্ষ্য।’
নির্দেশিকা তৈরির পক্ষে যুক্তি দিয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালাতে পারেন। তবে এর প্রয়োগ কখন বা কোন পরিস্থিতিতে তা করা যায়, তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আছে। এসব প্রক্রিয়া মেনে চলতে হবে। এর ফলে যত্রতত্র অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হবে বলে মনে করেন তিনি।
মানবাধিকার কমিশন এই নির্দেশিকা তৈরি করে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিতরণের জন্য।
মানবাধিকার কমিশন এ পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধের একটি ঘটনা নিয়েও কোনো তথ্যানুসন্ধান করেনি। এমনকি টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর মো. একরামুল হক নিহত হওয়া ঘটনার রেকর্ড করা অডিও প্রকাশ এবং এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হওয়ার পরও কমিশন তা নিয়ে কোনো তথ্যানুসন্ধান করেনি। মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একরাম নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে কোনো তথ্যানুসন্ধানের কাজ কমিশন করছে না।
নির্দেশিকা তৈরির না করে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান করে তা জনসমক্ষে প্রকাশকেই সঠিক কাজ হবে বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘টেকনাফের একরাম নিহত হওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে, এখানে বন্দুকযুদ্ধের নামে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। অন্তত এই একটি ঘটনা ধরে তথ্যানুসন্ধান করতে পারত কমিশন।’ মিজানুর রহমান বলেন, এই নির্দেশিকা প্রচার বা শিক্ষামূলক উপাদান হিসেবে ভালো। কিন্তু যখন মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, তখন সে বিষয়ে কোনো তথ্যানুসন্ধান না করা অন্যায্য।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কমিশনের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের প্রশিক্ষণের সময়েই এসব আইন সম্পর্কে জানতে পারেন। আর তাঁরা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আইনগুলোকে এক জায়গায় করে একটি নির্দেশিকা তৈরি করলে ভালো হয়।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় বড় ঘটনা নিয়ে এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার জানিয়ে কোনো সাড়া পায়নি মানবাধিকার কমিশন। এর উদাহরণ আছে। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১৮৫টি ঘটনার ক্ষেত্রে প্রতিবেদন চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু মন্ত্রণালয় এই সময়ে একটি চিঠিরও কোনো জবাব দেয়নি। নির্দেশিকা তৈরি করে তা কতটা কাজে লাগবে, তা নিয়ে সন্দিহান মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের নির্বাহী পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলান। তিনি বলেন, যে মন্ত্রণালয় কমিশনের কথায় পাত্তা দেয় না, তাদের জন্য নির্দেশিকায় কী হবে? আর এসব নির্দেশিকা না করে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে তথ্যানুসন্ধানের সঠিক কাজটি করা উচিত কমিশনের।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক অবশ্য মনে করেন, আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোও একটা বড় কাজ। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাব।’
সুত্রঃ- প্রথম আলো।
0 মন্তব্যসমূহ