লঞ্চের ফাঁকা ডেকেও টাকা ছাড়া মিলছে না সিট!

বিএন ডেস্কঃ
ত্রিশোর্ধ্ব রফিকুল ইসলাম। যানজট আর পথের বিপত্তি পেরিয়ে বেলা দেড়টায় পৌঁছান সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। তার হাতে-কাঁধে ভারী ব্যাগ। টপ টপ করে শরীর থেকে ঝরছে ঘাম। অনেক কষ্টে এসেছেন সদরঘাট। তবু মুখে ছিল না বিরক্তির ছাপ। হাস্যোজ্জ্বল চিত্তে হাতের বোঝা নিয়ে লঞ্চের দিকে ছুটছেন তিনি। লঞ্চের ডেকে চাদর বিছাতেই ঘটে বিপত্তি। লোকজন কম থাকলেও লঞ্চের পুরো ছাদেই চাদর বিছানো। হঠাৎ এক যুবক এসে সাফ জানিয়ে দেন, এখানে চাদর বিছাতে হলে ১৫০ টাকা দিতে হবে। এ নিয়ে শুরু হয় বাগি¦তণ্ডা শেষ হয় হাতাহাতিতে গিয়ে। পরে অন্য যাত্রীদের হস্তক্ষেপে ১০০ টাকায় সিট কিনে বসতে হয় রফিকুলকে। গতকাল ফারহান-৭ লঞ্চে এ ঘটনা ঘটে। শুধু রফিকুলই নন, তার মতো অনেক যাত্রী সদরঘাটে সিট বিক্রি চক্রের হাতে প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করলেও তেমন কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। 
অভিযোগ রয়েছে, লঞ্চ ঘাটের কিছু অসাধু শ্রমিক ও লঞ্চের দায়িত্বরত আনসার সদস্য এবং লঞ্চ কর্তৃপক্ষের কিছু লোকজন এ বাণিজ্যে জড়িত। এ বাণিজ্যে সদরঘাটে অর্ধশতাধিক চক্র সক্রিয়। এসব চক্র ঈদ মওসুম এলেই এই বাণিজ্যে মেতে ওঠে। কোনো যাত্রী এর প্রতিবাদ করলে শুধু নাজেহালই নয়, অনেক সময় এ চক্রের সদস্যদের হাতে মারধরেরও শিকার হন। 
এ দিকে কোরবানির ঈদের আর মাত্র দুই দিন বাকি। ফলে সময় যত ঘনিয়ে আসছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে বাড়ছে নাড়ির টানে গ্রামে যাওয়া মানুষের ভিড়। যেকোনোভাবেই হোক যেতে হবে বাড়িতে। তাই কোনো রকম একটু জায়গা পেলেই গাদাগাদি করে বসে পড়ছেন যাত্রীরা। এ সুযোগ নিয়ে লঞ্চের ফাঁকা ডেকে চাদর বিছিয়ে জমজমাট সিট বাণিজ্য করছে অসাধু চক্র। 
ফারহান-৭ লঞ্চের যাত্রী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি যখন লঞ্চের দোতলায় সিট নেয়ার জন্য উঠি; তখন অর্ধেক অংশে লোজজন ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ জায়গায় চাদর বিছানো ছিল। অনেকে ওই চাদর সরিয়ে নিজেদের বিছানা করলেই তারা দৌড়ে এসে টাকা নিয়ে যায়। অনেক সময় যাত্রীদের সাথে মারামারি ও হাতাহাতিও হয়। এ বিষয়ে লঞ্চের যাত্রীরা কর্তব্যরত আনসার সদস্যদের কাছে অভিযোগ করলে তারা কোনো সহায়তা করে না।
গতকাল সদরঘাটে সরজমিন ঘুরে সিট বাণিজ্য চক্রের দৌরাত্ম্য দেখা গেছে। পরাবাত-৯, কর্ণফুলী-১০, কর্ণফুলী-১১ ও কর্ণফুলী-১২ লঞ্চের অন্তত ২৫ যাত্রী অভিযোগ করেন তারা লঞ্চের ডেকে ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকায় সিট কিনে বসতে পেরেছেন। 
পরাবাত-৯ লঞ্চের যাত্রী সমির জানান, লঞ্চে ডেকে ভাড়া দিয়ে যেতে হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। সেখানে সিট কিনতেই হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কষ্ট দেখার মতো কেউ নেই। আনসাররাও চাদর বিছিয়ে সিট ব্যবসায় করে। সামনে গেলে নেম প্লেটে নাম পাওয়া যায়নি। নাম জানতে চাইলে উল্টো তেড়ে আসে। 
মানিক-৯, পূবালী-১, টিপু-৭ ও কির্ত্তনখোলা-১০ লঞ্চে ঘুরেও যাত্রীদের ওই একই অভিযোগ। টিপু-৭ লঞ্চের শাহীন নামে এক যাত্রী জানান, তিনি লঞ্চে এসেছেন তখন দুপুর ১২টা। অথচ লঞ্চ ছাড়বে রাত সাড়ে ৮টার পর। কিন্তু ঈদ মওসুমে সিট না পাওয়ার আশঙ্কায় বাড্ডা থেকে লঞ্চে এসে পৌঁছান। কিন্তু সেই তাড়াতাড়ি এসেও তাকে সিট কিনেই লঞ্চে বসতে হয়েছে। 
জানা গেছে, সদরঘাটের কুলি, লঞ্চের স্টাফ ও আনসার সদস্য এবং ঘাটের কিছু পাণ্ডার মদদে লঞ্চের সিট বাণিজ্য চক্রের অর্ধশতাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এরা শুধু কেবিনের টিকিট কালোবাজারি করেই ্যান্ত হয়নি, ডেকে কেউ চাদর বিছাতে গেলেই তাদের কাছ থেকেও অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে। যাত্রীরা এদের হাতে নানাভাবে নাজেহালও হচ্ছেন। 
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান রুমী কিসলু নয়া দিগন্তকে বলেন, লঞ্চের ফাঁকা ডেকে এভাবে চাদর বিছিয়ে সিট বাণিজ্য করার নিয়ম নেই। এটা কেউ করতে পারবে না। এ ঘটনায় যদি কোনো লঞ্চ স্টাফ জড়িত থাকেন তাহলে তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে। যদি কোনো বহিরাগত এর সাথে জড়িত থাকেন তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হবে।
নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবির বলেন, লঞ্চগুলোতে এ ধরনের সিট বাণিজ্য অবৈধ। যেসব লঞ্চে এ ধরনের সিট বাণিজ্য এবং যাত্রী হয়রানির ঘটনা ঘটবে ওই সব লঞ্চের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
 এন/ডি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ