বিএন ডেস্কঃ
অনেকটা ঢাকঢোল পিটিয়ে আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে তখন
বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে একের পর এক মামলা। বিশেষ করে
নতুন-পুরনো মামলায় হয়রান বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। মামলাকে কেন্দ্র
করে দৌড়াতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। ঢাকাসহ সারা দেশে ইতোমধ্যে প্রায় দেড়
হাজার মামলা হয়েছে। বিএনপির অভিযোগ- বারো হাজারের বেশি লোককে গ্রেফতারও করা
হয়েছে। আগামীতে আবারো ৫ জানুয়ারি মার্কা একতরফা নির্বাচন করতেই এসব করছে
সরকার। বিরোধী নেতাকর্মীদেরকে পরিকল্পিতভাবে নির্বিচারে গ্রেফতার করছে
পুলিশ। এমনকি মৃত ব্যক্তিও বাদ যায়নি পুলিশের মামলা থেকে। একাদশ জাতীয়
নির্বাচনে বিরোধী দলের সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের এলাকায় যেতে বাধা দেয়া
হচ্ছে। ফলে গণসংযোগ করতে পারছেন না তারা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
নেত্রকোনা-২ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে লড়তে চান জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক
অধ্যাপক ডা: আনোয়ারুল হক। কিন্তু গত পহেলা সেপ্টেম্বর বিএনপির
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পর থেকে তার বিরুদ্ধে নতুন মামলা হয়েছে তিনটি। তার
বিরুদ্ধে মোট মামলা ৯টি। নেতাকর্মীদেরকে চাপে রাখতেই মামলা দেয়া হচ্ছে বলে
তিনি মন্তব্য করেন। এভাবে ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশের তৃণমূলপর্যায়ের
নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দেয়া হচ্ছে বলে বিএনপির দফতর থেকেও
অভিযোগ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে একাদশ জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক মাঠে
ততই উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ক্ষমতার পালাবদলের নির্বাচন সন্নিকটে হলেও বিএনপি
নেতৃত্বাধীন জোট কিংবা সরকারের বাইরে থাকা অন্য দলগুলোর তৃণমূলকেন্দ্রিক
নির্বাচনী তৎপরতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। শুধু পোস্টার, ব্যানার আর গণমাধ্যমে
সরকারবিরোধী জোটের উপস্থিতি দেখা যায়। তাও অনেক জায়গায় বিএনপির সম্ভাব্য
এমপি প্রার্থীরা পোস্টার ব্যানার টাঙালেও তা ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ
পাওয়া গেছে। এই সুযোগে একাই নির্বাচনের মাঠ কাঁপাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী
লীগ।
মৃত ব্যক্তিও মামলার আসামি! এ দিকে মৃত ও বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিরাও
ভৌতিক মামলার আসামি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানা
পুলিশের এমন বায়বীয় মামলায় বিভিন্ন মহলে সমালোচনাও হচ্ছে। কামরাঙ্গীরচর
থানা বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগÑ ওপরের মহলকে খুশি করতে ওসি শাহীন ফকিরের
নির্দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক ভৌতিক ও বায়বীয় মামলা
দেয়া হচ্ছে। মৃত ও বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিরাও মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই
পাচ্ছেন না। জানা যায়, কামরাঙ্গীরচর থানা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি নূরুল
ইসলাম (৭১) গত ৩১ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। সেদিনই আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানে
তাকে দাফন করা হয়। মৃত্যুর পাঁচ দিন পর তাকে কামরাঙ্গীরচর থানায় গত ৫
সেপ্টেম্বর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়েরকৃত একটি মামলায় ৩১ নম্বর আসামি করা
হয়। এ ছাড়া ব্যবসায়িক কাজে হাজী নূর হোসেন গত ৩১ জানুয়ারি ভারতে থাকাকালে
তাকে একটি মামলায় অভিযুক্ত করে দেশে ফেরার পর গ্রেফতার করা হয়। সম্প্রতি
কয়েক দিনের ব্যবধানে কামরাঙ্গীরচর থানায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ছয়টি
মিথ্যা ও কাল্পনিক মামলা করা হয়েছে বলে থানা বিএনপির একাধিক নেতা অভিযোগ
করেন। কামরাঙ্গীরচর থানা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাজী মো:
মনির হোসেন জানান, ভবিষ্যতে একদলীয় শাসনব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে
পুলিশের লেবাসধারী আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের দিয়ে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে,
লেগুনা গাড়ির সিটে আগুন দিয়ে আমাকে ও আমাদের নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা
মামলা দিয়েই চলেছে। তবে কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি শাহীন ফকির গতকাল নয়া
দিগন্তকে বলেন, তার থানায় মৃত ব্যক্তির নামে মামলা হওয়ার কোনো ঘটনা নেই।
তারপরও তিনি খোঁজ নেবেন বলে মন্তব্য করেন।
এলাকায় যেতে হয়রানি : জানা গেছে, কোরবানির ঈদের আগে গ্রামের বাড়িতে
(বাগেরহাট-৪) গিয়েছিলেন বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ড. এ বি এম ওবায়দুল
ইসলাম। তিনি এলাকায় পৌঁছলে স্থানীয় ছাত্রদল-যুবদলের শতাধিক নেতাকর্মী
মোটরসাইকেল নিয়ে তার পেছনে পেছনে যেতে থাকেন। কিন্তু পুলিশ তাদেরকে যেতে
দেয়নি। শুধু ড. ওবায়দুল ইসলামকেই একা যাওয়ার অনুমতি দেন। অথচ তিনি কোনো
রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাননি বলে জানান। খুলনা-৩ আসনের খালিশপুর, দৌলতপুর,
খানজাহান আলী থানায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম
খালেদা জিয়ার কারামুক্তি, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের
মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার সংবলিত পোস্টার, ব্যানার এবং
ফেস্টুন সাঁটিয়েছিলেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি রকিবুল ইসলাম
বকুল। তিনি এই আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে আগ্রহী। কিন্তু সেসব
পোস্টার-ব্যানার দুষ্কৃতকারীরা ছিঁড়ে ফেলেছে বলে অভিযোগ করেন রকিবুল ইসলাম
বকুল। মাদারীপুর-১ আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী শিবচর উপজেলা বিএনপির
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইয়াজ্জেম হোসেন রোমান। তিনি বলেন, এলাকায় না যেতে
নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। মামলার ভয় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু তিনি
এসবকে উপেক্ষা করেও কৌশলে গণসংযোগ চালাচ্ছেন বলে জানান। ময়মনসিংহ-৯ আসনে
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী মামুন বিন আব্দুল মান্নান বলেন, তার এলাকার
নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। আরো বেশ কিছু
এলাকা থেকে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ঘটনা ছাড়াই আলামত তৈরি
করা হচ্ছে। প্রতিটি গ্রাম, ইউনিয়নে বানোয়াট মামলা আগাম দিয়ে রাখা হচ্ছে।
ঢাকার সব থানায়, ওয়ার্ডে আগাম মামলা দিয়ে রাখছে। নির্বাচন এলে এসব মামলায়
নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হবে। সরকার কতটা কাপুরুষ হলে এই ব্যবস্থাগুলো
নিতে পারে!
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এই সরকার একের পর
এক মিথ্যা মামলা দিয়েই চলেছে। প্রায় দেড় হাজার মামলা হয়েছে ইতোমধ্যে।
প্রতিদিনই গ্রেফতার করা হচ্ছে নেতাকর্মীদের। কিন্তু আওয়ামী নির্যাতনে
জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, যেকোনো সময় তার বিস্ফোরণ ঘটবেই।
অবৈধ সরকারের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে।
জানা যায়, গত শনিবার ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের নীলফামারীতে ট্রেনযাত্রার মাধ্যমে নির্বাচনী সফর শুরু করে আওয়ামী লীগ। পথে বেশ কয়েকটি পথসভাও করে দলটি। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আগামীকাল লঞ্চযোগে পটুয়াখালী সফরের কথা রয়েছে। এরপর বাইরোডে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ যাওয়ার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, গত শনিবার ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের নীলফামারীতে ট্রেনযাত্রার মাধ্যমে নির্বাচনী সফর শুরু করে আওয়ামী লীগ। পথে বেশ কয়েকটি পথসভাও করে দলটি। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আগামীকাল লঞ্চযোগে পটুয়াখালী সফরের কথা রয়েছে। এরপর বাইরোডে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ যাওয়ার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু স্বাভাবিক
প্রতিযোগিতার অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে নির্বাচন। একটি দেশ যত বেশি গণতান্ত্রিক
হবে, নির্বাচনে তত বেশি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হবে। নির্বাচনে সুষ্ঠু
প্রতিযোগিতার অর্থ হচ্ছে- দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত
হবে এবং সব দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ায় সমান সুযোগ ভোগ করবে।
সামগ্রিকভাবে দেশে নির্বাচনী প্রতিযোগিতার জন্য একটি সমতল মাঠ বা লেভেল
প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে। এই মাঠে নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলো সমান সুযোগ নিয়ে
তাদের নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রম চালানোর সুযোগ পাবে। দলগুলো জনগণের কাছে
তাদের বক্তব্য অবাধে তুলে ধরতে পারবে। কোনো দল এ ক্ষেত্রে কোনো পক্ষ থেকে
কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়বে না। আবার কোনো দল অবৈধভাবে বেশি সুযোগ পাবে না।
বিশ্লেষকদের বক্তব্য : বরেণ্যরাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে
নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে
ট্রেনযাত্রার মাধ্যমে। এখন বিএনপিকেও তৈরি হতে হবে। আওয়ামী লীগ ট্রেনে যাক
বিএনপিতে বাসে বা গাড়িতে যেতে পারে। তবে বৃহত্তর ঐক্য তৈরির কারণে কিছুটা
দেরি হচ্ছে বলে মনে হয়।
তিনি বলেন, এখন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে মামলাগুলো প্রত্যাহার এবং নতুন মামলা বন্ধ করতে হবে। নেতাকর্মীদেরও মুক্তি দিতে হবে। তা না হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও গ্রেফতারের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ মামলার কারণেই বিএনপি নির্বাচনী প্রচারে পিছিয়ে পড়ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, এখন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে মামলাগুলো প্রত্যাহার এবং নতুন মামলা বন্ধ করতে হবে। নেতাকর্মীদেরও মুক্তি দিতে হবে। তা না হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও গ্রেফতারের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ মামলার কারণেই বিএনপি নির্বাচনী প্রচারে পিছিয়ে পড়ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে
বলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে সবাইকে সমান
সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল
প্লেয়িং ফিল্ড নেই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
0 মন্তব্যসমূহ