আওয়ামী লীগের আমলেই বোমা হামলা শুরু হয়েছে মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বরাবরই সন্ত্রাসের উর্বর জমি হচ্ছে আওয়ামী লীগ। তাদের বক্তৃতা, আচরণ, দেশ শাসন সর্বত্রই রক্তাক্ত সন্ত্রাসের চিহ্ন দৃশ্যমান। আওয়ামী সন্ত্রাসের ধারা জেনেটিক্যাল। তারা শুধু গুম, খুন আর ক্রসফায়ারের ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে আইন আদালতকে গড়ে তুলেছে রাষ্ট্রীয় টেররিজমের হাতিয়ার হিসেবে।
তিনি শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যশোরে উদীচির অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, রমনা বটমূলে বোমা হামলা, কমিউনিষ্ট পার্টির জনসভায় পল্টনে বোমা হামলাসহ অসংখ্য বোমা হামলা হয়েছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে। তাহলে এগুলোর রায়ের পর্যবেক্ষণে এলো না কেন? এগুলোর জন্য আওয়ামী লীগ কেনো দায়ী নয়?
নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। লিখিত বক্তব্যে রিজভী বলেন, সাগর-রুনীসহ ৩৩ জন সাংবাদিককে হত্যার দায় কার? এটা কেনো রায়ের পর্যবেক্ষণে আসেনি? তনু, মিতু, রিশা-দিশাসহ অসংখ্য নারী পাশবিক নির্যাতন ও হত্যার শিকার হচ্ছে। শুধু টাঙ্গাইল জেলাতেই কলেজ ছাত্রী রুপাসহ চলন্ত বাসে তিন জন নারীকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এগুলি দুঃশাসনেরই ফলশ্রুতি। নারী নির্যাতনের এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কেনো রায়ের পর্যবেক্ষণে আসেনি? রায়ের পর্যবেক্ষণে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের কথা নাই কেন? বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রুপালী ও পুবালী ব্যাংক, ফার্মার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ শেয়ার মার্কেট হরিলুটের কথা রায়ের পর্যবেক্ষণে নেই কেন? এগুলো নিয়ে জনগণের মনে নানা প্রশ্ন দানা বাঁধছে।
তিনি বলেন, লক্ষীপুরের বিএনপি নেতা নজরুল ইসলামের হত্যাকারী সেখানকার আওয়ামী পৌর মেয়রের ছেলে বিপ্লব, নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মামলার প্রধান আসামি আওয়ামী মন্ত্রীর জামাই, উপজেলা চেয়ারম্যান নুর হোসেন বাবুর হত্যাকারিরা ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মী। প্রকাশ্য দিবালোকে কিশোর শ্রমিক বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সশস্ত্র ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। ঔদ্ধ্যতের চরম সীমা অতিক্রম করেছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এমপি পুত্র রনি রাস্তায় জ্যাম থাকার কারণে সামনের সিএনজিতে গুলি করে দু’জনকে হত্যা করেছে। আবার কয়েক দিন পরপর টেন্ডার দখল ও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগরাও নিজেরা নিজেদের লোকদের হত্যা করছে, রক্তাক্ত করছে জনপদ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রলীগের হাতে রক্তে রঞ্জিত। কেবল আধিপত্য বিস্তার নিয়েই ক্যাম্পাসগুলোতে নিজেরা একে অপরকে হত্যা করেছে। গণমাধ্যমে তথ্যানুযায়ী ছাত্রলীগের হাতে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির ভাগাভাগি নিয়ে খুন হয়েছে ২৭ জন।
ওবায়দুল কাদের সাহেবের উদ্দেশ্যে বলতে চাই- আপনাদের লোকদের কর্তৃক এত খুন-জখমের পরও কি আওয়ামী লীগের রেজিষ্ট্রেশন থাকা উচিৎ? আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বৈরাচারের টিকে থাকার মূল ভিত্তিই হচ্ছে সহিংস সন্ত্রাস।
রিজভী বলেন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা মহানগর পূর্বের সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম নয়নকে গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের গেট থেকে বিকেল চারটায় গোয়েন্দা পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে এখনো তার কোনো সন্ধান দিচ্ছে না। ৪২ ঘন্টা অতিবাহিত হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব থাকছে। তাদের এই নীরবতা নয়নের পরিবার ও দলের জন্য ভয় ও উদ্বেগজনক। অজানা আশঙ্কায় পরিবার ও দলের নেতাকর্মীরা প্রহর গুণছে। প্রকাশ্য দিবালোকে পোশাকধারী পুলিশের কাছ থেকেই তুলে নিয়ে গেছে। সুতরাং নয়ন গোয়েন্দা পুলিশের কাছেই আছে। আমি অবিলম্বে নয়নকে সর্বসম্মুখে হাজির করে পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দিতে আহবান জানাচ্ছি। বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসকে অনেকবার চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে অবশেষে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করানো হলেও মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসকরা রোগিকে চিকিৎসা দেবে না, এই দৃষ্টান্ত কেবল আওয়ামী শাসনামলেই দেখা যায়। প্রোষ্টেট গ্ল্যান্ড এনলার্জ, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হলেও শিমুল বিশ্বাসকে চিকিৎসা বঞ্চিত রাখা অমানবিক ও চরম নিষ্ঠুরতা। আমি অবিলম্বে শিমুল বিশ্বাসকে যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, দেশব্যাপী গায়েবী মামলার পর এখন বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদেরকে পাইকারী হারে গ্রেফতার শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মামলা দায়েরের তামাশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ৯ বছর, ২ বছর ও ১ বছর পূর্বে মৃত ব্যক্তিদের নামেও মামলা দেয়ার কথা আপনাদেরকে অবহিত করেছি। এই মামলা থেকে রেহাই পাননি দীর্ঘদিন থেকে হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকা পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীও। তামাশার আরও নজির দেখতে পাই- টঙ্গীতে ছাত্রলীগ সভাপতির নাম মামলায় চলে আসায় এজাহার পাল্টিয়ে তাকে বাদ দিয়ে নতুন এজাহার দেয়া হয়েছে। আমরা গণমাধ্যম থেকে জানতে পারলাম যে, দেশব্যাপী বিএনপি নেতাকর্মীদেরকে ধরার জন্য সাঁড়াশি অভিযান চালাতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে ওসিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং আইন ও বিচার যে সরকারের সম্পূর্ণ করায়ত্তে সেটার দৃষ্টান্ত বারবার দেয়ার দরকার নেই। তাই ২১ আগস্ট বোমা হামলার রায় আওয়ামী প্রধানের নির্দেশিত রায় সেটিও খুব সহজেই জনগণ উপলব্ধি করছে। এই রায়ের পক্ষে জনগণের কোনো সাড়া না পেয়ে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা উদ্ভ্রান্তের মতো কথা বলছেন।
দেশজুড়ে গ্রেফতারের চিত্র তুলে ধরে রিজভী বলেন, ঢাকায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় এক সপ্তাহে ৬টি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যট নিপুণ রায় চৌধুরীকে প্রধান আসামী করে ৭৪ জন নেতাকর্মীর নামে গত পরশু সন্ধ্যায় মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। কেরানীগঞ্জে ৬৭৮ জন নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে মামলা হয় এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জন নেতাকর্মীকে অজ্ঞাতনামা হিসাবে মামলায় জড়ানো হয়। প্রায় প্রতিদিন নেতাকর্মীদের বাড়ীতে বাড়ীতে পুলিশের তল্লাশি চলছে। বগুড়ায় জেলা যুবদল নেতা ফিরোজ হোসেন, মনিরুল, মোঃ কবিরুল ইসলাম, রুবেল হোসেনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ, আলমগীর মাহমুদ আলম, কাজী রানা, শাহ শিব্বির আহমেদ বুলু, রতন আকন্দ এবং কায়কোবাদ মামুনসহ ৩২ জন নেতাকর্মী, মহানগর ছাত্রদলের নাঈমুল করিম লুইন, তানভীর আহমেদ রবিনসহ ১২ জন ছাত্রনেতা, ত্রিশাল উপজেলার চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন এবং পৌর বিএনপির আমিন সরকারসহ সর্বমোট ৯৯ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সৌদি আরব পূর্বাঞ্চল বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম রফিকুল ইসলামকে গতকাল তার নান্দাইলের নিজ বাড়ী থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া নান্দাইলে ইউপি চেয়ারম্যান মো: রোকন উদ্দিন এবং এনামুল কাদির এনামসহ আজ ৪৬ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। কুমিল্লার লাকসাম বিএনপি নেতা মো: তাজুল ইসলাম, নাজমুল রশীদ রয়েল, মো: আমান, মো: বেলাল, মো: আলী আকবর, যুবদলের শাহ পরাণ, মো: মাসুদ, মো: মঞ্জুর হোসেন, মো: ইদ্রিস, মো: শাহজাহান, মো: সাইমুন, আবু সুফিয়ান হীরা, মো: মানিক, মো: জামাল, মো: আবু তাহের, উপজেলা শ্রমিক দল সভাপতি মো: সেলিম চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দিনাজপুর জেলা বিএনপি নেতা মোঃ সাবান এবং ধর্মপুর ইউনিয়ন বিএনপির মোঃ নুরুল ইসলামকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সৈয়দপুরে মোঃ ইউনুছ আলী বাবলু, শাকিল আহমেদ ও রঞ্জুকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
তিনি আরো বলেন, পটুয়াখালী জেলায় ২১ আগষ্ট বোমা হামলা মামলায় ফরমায়েসী রায়ের প্রতিবাদের অংশ হিসাবে বিক্ষোভ মিছিল শেষে দুমকি উপজেলা বিএনপি নেতা শহিদুল, শ্রমিক দলের মোঃ জাকির মোল্লা এবং খলিল আকন্দ, ছাত্রদলের ফিরোজ শিকদার, বিএনপি নেতা লতিফ হাওলাদার ও যুবদল নেতা মোঃ সবুজ হাওলাদারকে পুলিশ গ্রেফতার করে। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা যুবদলের নেতা মিন্টুকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কক্সবাজার জেলা ছাত্রদলের শহিদুর রহমান নয়ন, নোয়খালী সদর ছাত্রদলের মোঃ রায়হান ও পৌর ছাত্রদলের রনি সরোয়ার, বরিশাল মহানগর ছাত্রদল নেতা আবদুল্লাহ আল অভি, মোঃ রাহাত ও মোঃ পলাশকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পটুয়াখালীর দুমকিতে বিএনপি নেতা খলিলুর রহমান, সাইফুল আলম মৃধা ও জাহিদুল হক হাওলাদারসহ অজ্ঞাত নামা ৪৫ জনকে আসামী করে ১টি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়েছে। গায়েবিভাবে পুলিশ ১১টি বোমা ও ৩টি পেট্রোল বোমা নিজেরা সংগ্রহ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের মিথ্যাভাবে হেফাজত দেখিয়ে অত্র মামলা করেছে। এছাড়া ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ফেনী জেলা ছাত্রদলের শান্তিপূর্ণ মিছিল থেকে পুলিশ হামলা চালিয়ে ছাত্রদল নেতা শাহজাহান ও রুবেলসহ মোট ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। নাটোর জেলা ছাত্রদল নেতা জুবায়ের ও আফ্রিদিসহ ৫জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ছাগলনাইয়ায় মো: ফারুককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল সারা বাংলাদেশ থেকে মোট ১১ টি গায়েবি মামলার এজাহার পাওয়া গিয়েছে।
এরমধ্যে এজাহারে ১১৭৩ জনকে এবং অজ্ঞাত ২৬৪৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৪১৮২ টি মামলা এবং এজাহারে জ্ঞাত ৮৮,৭৭১ এবং অজ্ঞাত ২,৭৭,৮০৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। জ্ঞাত ও অজ্ঞাত মিলে সর্বমোট ৩,৬৬,৫৭৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এপর্যন্ত গায়েবী মামলায় বিএনপির ৪৯৭৬ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমি দলের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতারের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত মুক্তির জোর দাবি করছি।
0 মন্তব্যসমূহ