ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবারও তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ১৪
ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় অন্তত ৪৯ জন
জওয়ান নিহত হন। হামলার দায় স্বীকার করেছে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন
জইশ-ই মোহাম্মদ। ভারতের দাবি, পাকিস্তানের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা এ
সংগঠনের এতটা সাহস দেখানোর নেপথ্যে পাকিস্তান সরকারের মদদ রয়েছে। ভারতজুড়ে
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হলেও পাকিস্তান বলছে প্রমাণ দেখাতে।
তারপরই তদন্ত সাপেক্ষে তারা ব্যবস্থা নেবে। তবে এতটা রয়ে-সয়ে ব্যবস্থা
গ্রহণের মতো পরিস্থিতি ভারতের নেই। একে তো জনতা অত্যন্ত উত্তেজিত, তার ওপর
নির্বাচন সন্নিকটে। দুইয়ে মিলে তীব্র চাপের মধ্যে পড়েছে প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদির সরকার। ‘পাকিস্তান অনেক বড় ভুল করেছে’ বলে এ ব্যাপারে
ব্যবস্থা নেওয়ার দায় পুরোটা সেনাবাহিনীর ওপর অর্পণ করলেও পূর্ণ যুদ্ধ শুরু
করার অঙ্কটা সহজ হবে না।
কাশ্মীর সংকট
ব্রিটেনের কাছ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয় ভারত ও পাকিস্তান। কাশ্মীর পড়ে
ভারতের কাছে। মুসলিম অধ্যুষিত এই অংশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু থেকে দুই
দেশের মধ্যে সংকট চলছে। এরই মধ্যে তারা দুই দফা লড়াইয়ে জড়ায়। ১৯৬৫ সালের
যুদ্ধে কাশ্মীরের একটি অংশ দখল করে নেয় পাকিস্তান। সেটি ‘আজাদ কাশ্মীর’
নামে পরিচিত। কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয় ১৯৮৯
সালে। এই আন্দোলনে এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। গত বছরই মারা
গেছেন ৬০০ জন। জম্মু ও কাশ্মীরে বর্তমানে ভারতের পাঁচ লাখ সেনা অবস্থান
করছে। বিশ্বের সবচেয়ে সামরিক উপস্থিতিসম্পন্ন অঞ্চল এটি। কাশ্মীর ভারতের
কেন্দ্র শাসিত রাজ্য। জঙ্গি হামলা কাশ্মীরে নতুন নয়। ২০০২ সালে জম্মুতে
সেনা ক্যাম্পে জঙ্গি হামলায় ৩৪ সেনা নিহত হন। তিন বছর আগে উরি সেনা
ক্যাম্পে হামলা চালায় জঙ্গিরা। নিহত হন ১৯ সেনা। তবে সেসব ঘটনাকে ছাপিয়ে
গেছে এবারের হামলাটি। ৭৮টি বাসে করে আধাসামরিক বাহিনী সেন্ট্রাল রিজার্ভ
পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) প্রায় আড়াই হাজার জওয়ান ছুটি শেষে কাজে যোগ দিতে
যাচ্ছিলেন। শ্রীনগর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে পুলওয়ামার সড়কে ঢোকার পর
বিস্ফোরকভর্তি একটি জিপ বহরের দুটি বাসে ধাক্কা দেয়। ওই জিপে প্রায় সাড়ে
তিন শ কেজি বিস্ফোরক ছিল। ৪৯ জওয়ান ওই হামলায় নিহত হন।
হামলার দায় স্বীকার করা জইশ-ই মোহাম্মদের মূল ঘাঁটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব
প্রদেশে। তাদের নেতা মাসুদ আজহার দীর্ঘদিন ভারতের কারাগারে বন্দি ছিলেন।
পরে জঙ্গিরা ভারতের একটি যাত্রীবাহী বিমান জিম্মি করলে তিনি ছাড়া পান। জানা
গেছে, পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গেও সখ্য রয়েছে
আজহারের। ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের হয়ে গত নির্বাচনের প্রচারে
অংশ নিয়েছেন তিনি।
ভারতের অবস্থান
ঘটনার পরপরই তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ভারত। পাকিস্তানকে দেওয়া
‘বিশেষ রাষ্ট্রের’ মর্যাদা প্রত্যাহার করা হয়। পাকিস্তানি পণ্যের ওপর ২০০
শতাংশ শুল্কও ধার্য করে তারা। হুমকি দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
পাকিস্তানকে একঘরে করে ফেলার। কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষার স্বার্থে সরকারের
পক্ষ থেকে কিছুটা রয়ে-সয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানো হলেও সাধারণ মানুষ ক্ষোভে
ফেটে পড়ে।
কী করতে পারে ভারত?
একসঙ্গে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামরিক প্রত্যাঘাতের কথা
বলছেন অনেকে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যেসব বিকল্প আছে, তার কোনোটাই
ভারতের পক্ষে সহজ হবে না। কারণ পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশের
বিরুদ্ধে চরম কোনো পথ নেওয়া কঠিন। ভারত সরকারের ওপর বিরোধী দল এবং জনগণের
পক্ষ থেকেও সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে চাপ রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন
হচ্ছে, সে রকম প্রত্যাঘাত আবারও পাল্টা আঘাত টেনে আনবে কি না! কারণ দুটোই
পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চটজলদি প্রত্যাঘাত
কার্যকর হবে না। ভারতের প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কৌশল।
ত্রুটি ছিল ভারতেরও
জানা গেছে, জঙ্গিরা হামলা চালাতে পারে—এমন গোয়েন্দা তথ্য ছিল সাত দিন
আগে থেকেই। বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি গাড়িবহর যখন যাচ্ছিল, তখনো
জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে সেই
কথাবার্তার রেকর্ডও ছিল। প্রশ্ন রয়েছে ৭৮ গাড়ির বহর নিয়েও। কারণ এত বড় কনভয়
হলে বিপদের আশঙ্কা বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে হয়েছেও তা-ই।
পাকিস্তানের এক কথা
ভারতে বিভিন্ন সময় জঙ্গি হামলার পর বরাবর যা বলে এসেছে পাকিস্তান,
পুলওয়ামা হামলার পর সে কথাই আউড়ে গেছে তারা। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শাহ মামুদ কোরেশি এক টুইটে বলেন, পুলওয়ামা কাণ্ডে পাকিস্তানের
ইন্ধনসংক্রান্ত কোনো তথ্য-প্রমাণ ভাগ করে নিলে তদন্তে পূর্ণ সহায়তা করা
হবে। কিন্তু তা না করে পাকিস্তানকে একতরফা দোষারোপ করে কিংবা চোখ রাঙিয়ে
কোনো লাভ হবে না। গোটা বিশ্বও তা মানবে না। তবে ভারতের দাবি, জঙ্গি হামলায়
পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট থাকার তথ্য বা নথি ইসলামাবাদকে বহুবার দেওয়া হয়েছে।
তবে তারা কখনোই তাতে গুরুত্ব দেয়নি।
/ কালের কন্ঠ /
0 মন্তব্যসমূহ