আদর্শ ত্যাগ না করে, একাত্তরে দলের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি তোলা এবং কোন ভূমিকা তা স্পষ্ট না করাকে জামায়াতেরই রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বলে মনে করছেন দল হিসেবে জামায়াতের বিচার মামলার আইনজীবী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা।
তারা বলছেন, অতীতের মতোই রঙ বদলানোর কৌশল হিসেবে কেবল দল টেকানোর উদ্দেশ্যে এধরনের বক্তব্য দিয়েছেন জামায়াতের সদ্য পদত্যাগকারী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধ ও বিচারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরই তারা এধরনের অপকৌশল নিয়েছে বলেও মন্তব্য তাদের। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের ঘোষণার পর বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যেমন চলছিল, চলবে।
গত শুক্রবার একাত্তরে দলের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। সেই সঙ্গে জামায়াতকে নতুন আঙ্গিকে সাজানোর কথাও বলেছেন তিনি। যদিও এই একই কথা বলে কারাগার থেকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। ফলে দীর্ঘদিন থেকেই জামায়াত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় রঙ বদলে নতুন মোড়কে আসার নানা কৌশল ভাবছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, আ. রাজ্জাক তার বক্তব্যের কোথাও জামায়াতের আদর্শ নিয়ে কিছু না বলে একাত্তরের ভূমিকা বলে পাশ কাটিয়ে গেছেন, এটি কেবলই মওদুদীবাদকে যে কোনোভাবে ভিন্ননামে হলেও টিকিয়ে রাখারই কৌশল।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই গ্রেফতার হন কামারুজ্জামান। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৭ নম্বর সেল (বকুল) থেকে গোপনে দলের উদ্দেশ্যে চিঠি পাঠিয়ে জামায়াতের টিকে থাকার কৌশল হিসেবে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব করেন। তিনি চেয়েছিলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছন থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের বক্তব্য জামায়াত পুনর্বাসনের রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি উল্লেখ করে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘ ব্যারিস্টার রাজ্জাক নিজে দলটির একটি পদে আসীন ছিলেন, তিনি শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান আইনজীবী, তিনি লবিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন এবং তার নিজের বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ছিল। সেসব ডিফেন্ড না করে, কোন ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত তা স্পষ্ট না করে কেবল ‘ক্ষমা চাওয়া উচিত’ধরনের বক্তব্য জামায়াত পুনর্বাসনের রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি ছাড়া কিছু না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘মজলিসে শুরার সিদ্ধান্ত হয়েছে তারা নাম বদলাবে। সেক্ষেত্রে তাদের শীর্ষনেতার এ ধরনের ঘোষণা সাংঘর্ষিক ।’
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের এধরনের ঘোষণাকে জামায়াতের কৌশলের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘‘গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক তার গন্ধে তাকে টের পাওয়া যাবে। তারা দলটাকে টিকিয়ে রাখতে নানা কৌশল নেবে এটা স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী দলটি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঘোষণা দেওয়ার পর তারা চেয়েছে এমন কৌশল নিতে যাতে ‘জামায়াত’ নামটি বিলুপ্ত হয়, আদর্শ নয়। আর নাম না থাকলে তার বিচার বা তাকে নিষিদ্ধ করা কোনটিই কাজে আসবে না।’’
তবে যে কৌশলই নিয়ে থাকুক বিচার প্রক্রিয়া এড়ানো দলটির পক্ষে সহজ হবে না। শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর জামায়াতের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে। যদিও অফিসিয়ালি তারা এখনও কিছু বলেনি। তবে ক্ষমা চাইলেও যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার চলছে, সেটা বন্ধ হবে না।’
এদিকে, যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন আবারও সংশোধন করা হচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত মনে করেন, ‘মোহাম্মদ কামারুজ্জামান কারাগার থেকে জামায়াতকে পুনর্গঠনের যে কৌশল পাঠিয়েছিলেন সেই পথেই হাঁটছে দলটি। জামায়াত নামটি বদলে ফেলা, দলকে নতুন ফর্মে গঠন করা, মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকৃতি দেওয়ার কাজগুলো করে ভিন্ন নামে থাকার কৌশল নিচ্ছেন এখন দলটির নেতারা। তারা কেউই কখনো বলেননি আমরা দলটির দর্শন থেকে বেরিয়ে আসতে চাই বা এই দর্শন প্রত্যাখ্যান করবো। সেদিন কামরুজ্জামানও বলেননি, আজকে আব্দুর রাজ্জাকও বলেননি। বরং ব্যারিস্টার রাজ্জাক দলকে প্রত্যাখ্যান করলেও দলটির দর্শন প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে নীরব।
জামায়াতে ইসলামের একটা অংশের এটা কৌশল উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, ‘‘এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনার কথা বলা হয় তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নতুন সঙ্কট তৈরি হবে। কারণ, তারা এই কৌশল নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গ্রহণযোগ্যতা আদায়ের চেষ্টা করবে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, ‘৭১ -এ জামায়াত যে দর্শন ধারণ করতো এখনও সেই ধারাতেই চলে আসছে।’ আদালতের একটি অভিমত ছিল যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমাজ রাজনীতি এমনকি পারিবারিকভাবেও তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। এসব কারণে তারা এখন নতুন বোতলে পুরনো মদ রাখার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক।’’
এদিকে, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের দল ছাড়ার ঘোষণা ও দলের নাম পরিবর্তনের চিন্তাকে ‘কৌশল’ না বলে ‘সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র্’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী তার সম্পত্তি, দলের আদর্শকে রক্ষার জন্য এবং গণহত্যার দায় এড়ানোর জন্য নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। এখন কেউ কেউ পদত্যাগ করবে, কেউ অন্য দলে যাবে, নতুন নামে কিছু খুলবে। সংগঠন হিসেবে বিচারের সম্ভাবনা দেখে মওদুদীর দর্শন কায়েম রাখার জন্য তারা এটা করছে।’
ব্যারিস্টার রাজ্জাক জামায়াতের দর্শন নিয়ে কোনও কথা বলেননি উল্লেখ করে শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘একাত্তরে কিসের জন্য, কোন ভূমিকার জন্য জামায়াত ক্ষমা চাইবে তা স্পষ্ট করেননি আব্দুর রাজ্জাক। মনে করার কোনও কারণ নেই যে তিনি যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। ফলে উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যারিস্টার রাজ্জাক নিজেও আলবদর বাহিনীতে ছিলেন। দৃষ্টি সরানোর জন্য জামায়াত কোণঠাসা হলেই আহমদিয়াদের ওপর হামলা হয়। ওদের এই কৌশল অপকৌশল, জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে।’
/বাংলা ট্রিবিউন!
0 মন্তব্যসমূহ