বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলটি এগিয়ে যাচ্ছে অনিবার্য গন্তব্য ধ্বংসের দিকে। জামায়াতের কফিনে প্রথম পেরেকটি ঠুকেছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। একসময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। সেই পদ তিনি ত্যাগ করেছেন। চতুর ব্যারিস্টার রাজ্জাক আসলে অনেক আগেই জামায়াত ত্যাগ করেছেন, এমনকি দেশও ছেড়েছেন। দলের নেতাদের ফাঁসি ঠেকাতে না পেরে অনেকটা চোরের মতো তিনি বিলাতে পালিয়ে যান। সেখান থেকেই তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।
ঘটনা যাই হোক, পদত্যাগের সময় সবাই অনিবার্য কারণ বা ব্যক্তিগত কারণের কথা উল্লেখ করে আসল কারণটা এড়িয়ে যান। কিন্তু এদিক দিয়ে সৎ ব্যারিস্টার রাজ্জাক। তিনি পাঁচ পৃষ্ঠার চিঠিতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট কারণ ব্যাখ্যা করে দল ছেড়েছেন। তার দাবি,তিন দশক ধরে চেষ্টা করেও একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ক্ষমা চাওয়াতে পারেননি। মহৎ চেষ্টা, নিদারুণ ব্যর্থতা। কিন্তু ব্যারিস্টার রাজ্জাকের কাছে একটা প্রশ্ন, জামায়াতে ইসলামীর একাত্তরের ভূমিকা যে ক্ষমা চাওয়ার মতো, সেটা তো আপনার নতুন উপলব্ধি নয়, তিন দশক আগে থেকেই জানতেন। একাত্তরে তারা যদি ক্ষমা চাওয়ার মতো ভুল করেই থাকে, তাহলে আপনি সেই ভূমিকার জন্য দায়ী নেতাদের পক্ষে দিনের পর দিন আদালতে দাঁড়িয়ে সাফাই গাইলেন কোন মুখে? আপনারও তো এদের বিচার চাওয়া উচিত ছিল। জামায়াতের ক্ষমা চাওয়ার আগে ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের দায়ে ব্যারিস্টার রাজ্জাকেরও তো ক্ষমা চাওয়া উচিত।
তবে মানতেই হবে পদত্যাগের জন্য মোক্ষম সময় বেছে নিয়েছেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। জামায়াতের ভেতরে যখন নজিরবিহীন অনৈক্য, অস্থিরতা, বিভক্তি, গণমাধ্যমে যখন জামায়াত নিয়ে লেখালেখি, রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা– তখন তিনি আঘাতটা করেছেন। ব্যারিস্টার রাজ্জাক জানেন, লোহা গরম থাকতেই আঘাত করতে হয়। তাই সময় বুঝেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। জামায়াতের তরুণ কর্মীরা সংগঠনের কফিন তৈরি করছিলেন, ব্যারিস্টার রাজ্জাক সেই কফিনে প্রথম পেরেকটি ঠুকলেন, হয়তো তিনিই নেতৃত্ব দেবেন জামায়াত বিলুপ্তির।
সবাই জামায়াতকে ক্যাডারভিত্তিক, আদর্শিক সংগঠন হিসেবেই জানতো। এই সংগঠনে কোনও গ্রুপিং নেই, আদর্শ নিয়ে বিরোধ নেই, নেতা নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই– এমনটাই জানতো সবাই। কিন্তু অনিবার্য পরিণতির সামনে দাঁড়িয়ে জামায়াতে আজ বহু মত, বহু পথ। মৃত্যুর আগে হঠাৎ যেন জামায়াত গণতান্ত্রিক দল হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন অনেকগুলো- ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর বিএনপির কাছে ২০ দলের গুরুত্ব কমে গেছে। স্বাভাবিকভাবে গুরুত্ব কমেছে জামায়াতেরও। গত নির্বাচনে অনেক নাটকের পর বিএনপি ভিক্ষা দেওয়ার মতো করে ২২টি আসনে জামায়াত প্রার্থীদের ধানের শীষ দিয়েছিল। অবশ্য নিবন্ধন না থাকায় জামায়াতের উপায়ও ছিল না, বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েই নির্বাচনে যেতে হতো তাদের। কিন্তু জামায়াতকে ধানের শীষ দেওয়ায় মাইন্ড করেছেন তাদের নতুন নেতা ড. কামাল হোসেন। তাই ড. কামালের মান ভাঙাতে বিএনপি জামায়াতকে দূরে দূরে রাখছে। তাতে অভিমান করেছে জামায়াত। দাবি উঠেছে ২০ দল থেকে বেরিয়ে নিজেদের মতো পথ চলার। তাদের ধারণা, বিএনপির সঙ্গে থাকার কারণেই গত ১০ বছর ধরে তারা সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনে পিষ্ট।
তবে জামায়াতের মূল বিরোধ, একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে। তরুণ অংশটি চায়, একাত্তরের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নবযাত্রা শুরু করতে। তারা প্রয়োজনে দল বিলুপ্ত করে নতুন নামে দল করতে চায়। আবার কেউ কেউ রাজনীতি বাদ দিয়ে জামায়াতকে সামাজিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে চান। কারণ বিএনপিকে ছাড়লে নিবন্ধনহীন জামায়াতের রাজনীতি করা কঠিন হবে। তাই, হয় তাদের নতুন নামে দল করে নিবন্ধনের চেষ্টা করতে হবে অথবা রাজনীতি ছাড়তে হবে।
তবে মূল প্রশ্নটি একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া না চাওয়ার। এ ব্যাপারে ব্যারিস্টার রাজ্জাক তার পদত্যাগপত্রে বিস্তারিত লিখেছেন, ‘একাত্তরে মুক্তিদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে জামায়াতের সকল সাফল্য ও অর্জন ম্লান করে দিয়েছে। আমি সব সময় বিশ্বাস করেছি এবং এখনও করি যে, ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে নেতিবাচক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয় বরং তৎপরবর্তী প্রজন্মকে দায়মুক্ত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘যে কোনও রাজনৈতিক দল, ইতিহাসের কোনও এক পর্বে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ত্রুটি-বিচ্যুতির শিকার হতে পারে। কিন্তু তাকে ক্রমাগত অস্বীকার করে, সেই সিদ্ধান্ত ও তার ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান বজায় রাখা শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয় বরং আত্মঘাতী রাজনীতি। একাত্তরের ভূমিকার জন্য গ্রহণযোগ্য বক্তব্য প্রদানের ব্যর্থতা এবং ক্ষমা না চাওয়ার দায়ভার এখন তাদেরও নিতে হচ্ছে, যারা তখন ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত ছিল না, এমনকি যাদের তখন জন্মও হয়নি।’
প্রথম কথা হলো, একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা কি নিছক নেতিবাচক? একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা যদি নিছক রাজনৈতিক বিরোধিতার হতো, তাহলে সেটা ভুল হিসেবে বিবেচিত হতে পারতো। ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু একাত্তরে জামায়াত যা করেছে, সেটা ভয়ঙ্কর অপরাধ। একাত্তরে অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। তাদের অনেকে মনে করেছে, মুক্তিযুদ্ধ আসলে ‘মুসলমানদের পাকিস্তান’ ভাঙতে ‘হিন্দুদের ভারতের’ ষড়যন্ত্র। তাদের কেউ কেউ আদর্শিক বিশ্বাস থেকে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিলেও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত হননি। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। তারা রাজাকার, আল বদর, আল শামস গঠন করে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মিলে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজে অংশ নিয়েছে। সকল স্বাধীনতা বিরোধী কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধী নয়।
সব স্বাধীনতা বিরোধীকেই আমি ঘৃণা করি। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার হচ্ছে না; হচ্ছে একাত্তরে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের। আপনি শুধু রাজনৈতিক কারণে একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধিতা করে থাকলে এবং এখন সেই ভুল বুঝতে পারলে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন। কিন্তু যদি আপনি পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মিলে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে থাকেন, তাহলে কেবল ক্ষমায় আপনার দায়মুক্তি হবে না। ভুলের ক্ষমা হয়, অপরাধের হতে হয় বিচার। যে বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের বিচার তো হচ্ছেই, ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীকেও যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদেরও বিচার হবে। নিছক ক্ষমা চেয়ে বা নাম বদলে এই বিচার এড়ানো যাবে না। জামায়াত তো শুধু দেশ ও জাতির প্রতি অপরাধ করেনি, ব্যক্তির প্রতিও করেছে। আমি বা আপনি না হয় জামায়াতকে ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু নুজহাত চৌধুরী, যার পিতা ডা. আলিম চৌধুরীকে একাত্তরে আল বদররা তুলে নিয়ে হত্যা করেছে, তিনি ক্ষমা না করলে? আর মানবতাবিরোধী অপরাধ কখনও তামাদি হয় না। তাছাড়া নাম বদলালেও স্বভাব বদলায় না। ইসলামী ছাত্র সংঘ পরে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে তৎপরতা শুরু করে। কিন্তু তাদের সন্ত্রাসী চরিত্র একটুও বদলায়নি।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক কিন্তু ঠিকই বুঝেছেন, জামায়াত একটি গণবিরোধী দল। তাই তো তিনি লিখেছেন, ‘এই ক্রমাগত ব্যর্থতা জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসাবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। ফলে জামায়াত জনগণ, গণরাজনীতি এবং দেশ বিমুখ দলে পরিণত হয়েছে।’
সবচেয়ে বড় কথা জামায়াতের অপরাধ তো শুধু একাত্তরে সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৪১ সালে মওদুদী প্রতিষ্ঠিত দলটির মূল সমস্যা আদর্শে। পাকিস্তান আমলেও মওদুদী গ্রেফতার হয়েছে। একাত্তরের পরেও জামায়াতের অপতৎপরতা থামেনি। এখন বাধ্য হয়ে ক্ষমার কথা বললেও, তারা কখনও একাত্তরের অপরাধের জন্য অনুশোচনা করেনি। এখনও একটি বড় অংশ ক্ষমা চাওয়ার বিপক্ষে। তারা মনে করে ক্ষমা চাইলে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলা দলের নেতাদের অবমাননা করা হয়।
তাই আমরা জামায়াতের ক্ষমা নয়, বিচার চাই। ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ চাই। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার শুধু বাংলাদেশের পক্ষের মানুষের, স্বাধীনতার পক্ষের দলের।
/বাংলা ট্রিবিউন!
0 মন্তব্যসমূহ