এই হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে জাতিবিদ্বেষ থেকে ঘটেছে। ঘাতক ওই অঞ্চলকে শুধু শ্বেতাঙ্গদের বলেই মনে করতেন। ফলে অন্যদের মনে করতেন বহিরাগত। তাঁর দৃষ্টিতে, তাঁর চারপাশে থাকা অশ্বেতাঙ্গ মাত্রই ‘ইনভেডার’, যাঁরা এসে তাঁদের অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে কলুষিত করছে। এই ভাবনাতেই লুকিয়ে আছে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটি। এই ধারণাই তাকে ‘নিজ’ ও ‘অন্য’ ধারণার দিকে নিয়ে গেছে, যেখানে অন্য মানেই ঘৃণার বস্তু। শুধু তা-ই নয়, এই ঘৃণা সম্প্রচারেরও বস্তু।
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে একই দিনে জুমার নামাজের সময় হামলা করা হয়, যেখানে মারা যায় ৪৯ জন। আল নুর মসজিদে হামলার ভিডিওটি সরাসরি সম্প্রচার হয় ফেসবুকে। এই ভিডিও এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সেন্সরও থামাবার সময় পায়নি। ভিডিওটি ছিল অনেকটা হাই ডেফিনেশন গেমের মতো, যেখানে খেলোয়াড়ের দায়িত্ব থাকে পর্দায় যাকে পাওয়া যাবে, তাকেই হত্যা করা। ১৭ মিনিটের এ ভিডিও নিঃসন্দেহে ছিল অমানবিকতার এক ভয়াবহ প্রদর্শনী।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো সন্ত্রাসী হামলার ভিডিও তৈরিই করা হয় সন্ত্রাসকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে। এ ধরনের ভিডিও একই সঙ্গে আরও অনেককে উদ্দীপ্ত করে। আর আতঙ্ক ও উদ্দীপনা এ দুই বৈশিষ্ট্যই যেকোনো কিছুকে ভীষণভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, রেডিট, ফোরচ্যান—এ ধরনের সহিংস ও অমানবিক ভিডিও প্রচারের বিরোধী। তারা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে ভিডিওটি অসংখ্য মানুষ ডাউনলোড করে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারকারীদের পোস্টে এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও অথবা ছবি ঝুলছে। একই সঙ্গে ঘাতকের ইতিহাসও সবার জানা হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘেঁটে বের করা হয়েছে তার ডিজিটাল ইতিহাস। এমনকি তার শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী মেনিফেস্টোটি সম্পর্কেও এখন কম-বেশি সবাই জানে। এই সবকিছুই ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটের প্রতিটি কোণে। আর এর মধ্য দিয়ে ঘাতক কিন্তু তার অভীষ্টে ঠিকই পৌঁছে গেছে। সবার দৃষ্টি আকর্ষণের কাজটি একটি ভয়ংকর হামলা এবং তার সম্প্রচারের মধ্য দিয়ে বেশ ভালোভাবে করতে পেরেছেন তিনি।
হামলা ও তার সরাসরি সম্প্রচারের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এমনটা এর আগেও ঘটেছে। নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, এক ঘাতক ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার দুই সাংবাদিককে হত্যার ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করেছিল তার টুইটার অ্যাকাউন্টে। এর কিছুদিন পরই এক তরুণীর আত্মহত্যার ঘটনা সরাসরি সম্প্রচারের কারণে লাইভ স্ট্রিমিং অ্যাপ পেরিস্কোপ নিষিদ্ধ করা হয়। ফেসবুকে এর আগেও বহু হত্যাকাণ্ড সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। পুলিশের করা এনকাউন্টারের ভিডিও রয়েছে প্রচুর। এমনকি শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনাও সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে।
বাংলাদেশেও এমনটা দেখা গেছে। হোলি আর্টিজান হামলায় যেমন ঘাতকদের দেখা যায় বিশেষ পোশাক ও নানা চিহ্ন বহন করতে, একই সঙ্গে দেখা যায় তা প্রচারের ব্যবস্থা করতে। গাছের সঙ্গে বেঁধে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ভাইরাল হওয়ার ঘটেছে এই বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলার সময় আটক আকায়েদ উল্লাহ দীক্ষা নিয়েছিলেন ইন্টারনেট থেকেই। অর্থাৎ এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বিশ্বগ্রামের সবখানেই।
ওপরে বর্ণিত ঘটনাগুলোর ব্যাপ্তি ও ধরন বিবেচনা করলে ক্রাইস্টচার্চের ঘটনাটিকে ঘাতকের পরিচিতির পরিসরের কারণেই কিছুটা আলাদা মনে হতে পারে। ক্রাইস্টচার্চের ঘাতক ইন্টারনেটের সবচেয়ে অন্ধকার অংশটির সঙ্গে পরিচিত ছিল। কিন্তু এ তো সত্য যে অনলাইনে বিদ্যমান ‘অনুকরণের সংস্কৃতি’র বহু স্বাক্ষর রয়েছে ঘাতকের সার্বিক কার্যক্রমে। এ ক্ষেত্রে হামলার ঠিক আগে আগে ইউটিউবে জনপ্রিয় একজনকে খুঁজে বের করার চেষ্টাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই সন্ত্রাসী হামলার হোতার ডিজিটাল ইতিহাস এখন প্রকাশিত। ৮৭ পৃষ্ঠার মেনিফেস্টো থেকে তাঁর মধ্যে থাকা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের ধারণার গভীর শিকড়টি বেশ স্পষ্ট। এই সন্ত্রাসী আবার একই সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভক্ত, যিনি আবার টুইটার প্রেসিডেন্ট নামে পরিচিত। তিনি তাঁর টুইটার পোস্টকে বিতর্ক উসকে দেওয়া ও বিভাজন তৈরিতে ব্যবহার করেন—এ কথা সবাই জানে। ঘাতকের মেনিফেস্টোতে রয়েছে নানা কট্টর মত, জাতিবিদ্বেষের নানা উপাদান; রয়েছে ‘অন্য’দের নিয়ে তামাশা। এই সবই আবার মিলে যায় এখনকার লোকরঞ্জনবাদী শাসকদের প্রবণতা ও প্রকাশের সঙ্গে। সব মিলিয়ে ঘাতক ইন্টারনেট সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন, এটা নিশ্চিত। একই সঙ্গে এও স্পষ্ট যে, তিনি এই ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কী করে বিতর্ক উসকে দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনে ও নিজস্ব মত প্রচারে ব্যবহার করা যায়, তা-ও জানেন।
ফলে সবকিছুর পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ও এর কমিউনিটিগুলো অনেকটা অজান্তেই ঘাতকের হয়েই কাজ করতে থাকে। এর মাধ্যমে এই ঘৃণা ও সন্ত্রাস আর এক জায়গায় আবদ্ধ থাকছে না। ছড়িয়ে পড়ছে। এটাই হচ্ছে এই সময়ের নতুন বাস্তবতা। এই বাস্তবতায় কোনো সন্ত্রাসীকে দল গড়তে দিনের পর দিন লেগে থাকতে হয় না। তৈরি করতে হয় না প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এই ঘৃণা ও প্রশিক্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিলেই হলো। সেন্সরের পর ব্যবস্থা গ্রহণের আগেই তা পৌঁছে যাবে অসংখ্য মানুষের কাছে, যাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ নিয়ে নেবে আবার ঘৃণার নতুন পাঠ। এমনটাই হচ্ছে। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়, এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয় বিভিন্ন অনলাইন-অফলাইন গেমসের কথা, যেখানে হত্যাই একমাত্র খেলার বস্তু। এ দুইয়ের মেলবন্ধনে বিশ্ব এমন এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে, যেখানে যে কেউ যখন-তখন পূর্বসংকেত ছাড়াই হয়ে উঠতে পারে অস্ত্রবাজ ও ঘাতক।
ক্রাইস্টচার্চে যে হামলাটি হয়েছে, মূলগতভাবে তার দুটি দিক রয়েছে। এক, জাতিবিদ্বেষ এবং দুই, ওয়েব জনপ্রিয়তার নেশা। বিশ্বজুড়ে জাতিবিদ্বেষ ও তা থেকে উদ্ভূত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দিন দিন বাড়ছে। এ নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে বিস্তর। কিন্তু দ্বিতীয় প্রসঙ্গটিও কম সংহারী নয়, যা থেকে যাচ্ছে আলোচনার বাইরে। কিন্তু এই আলোচনাটিও সমান গুরুত্বে সামনে আসার সময় এসে গেছে।
0 মন্তব্যসমূহ