চন্দনাইশের বৈলতলীতে পিতৃহীন তরুণী সোলতানা সাদিয়া রিনা’র স্বপ্ন পূরণের পাঠশালায় বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়ছেন হতদরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা



দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা যাতে পড়ালেখা থেকে ঝরে না পড়ে এবং মানসম্মত শিক্ষা অর্জণ করতে পারে সেজন্য এলাকার দরিদ্র পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়াচ্ছেন চন্দনাইশ উপজেলার বৈলতলী ইউনিয়নের জাফরাবাদ ফাজিল মাদ্রাসার আই.সি.টি প্রভাষক সোলতানা সাদিয়া রিনা। উপজেলার বৈলতলী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের বুড়ির দোকান সংলগ্ন আমজু মিয়া তালুকদার বাড়িতে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ‘স্বপ্ন পূরণের পাঠশালা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।


 প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার পড়তে আসে এলাকার ২০ জন ছাত্র-ছাত্রী, যারা পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে সোলতানা সাদিয়া রিনা একাই বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়াচ্ছেন ১ম-১০ম শ্রেণীর দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের। পরবর্তীতে তার এই মহতি উদ্যোগের সাথে যোগ দেন আনোয়ারা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী অনিক চৌধুরী, গাছবাড়ীয়া সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম সবুজ, ফরিদুল ইসলাম, রুমি বিশ্বাস, বরমা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী রিমা বিশ্বাস, চট্টগ্রাম সিটি কলেজের শিক্ষার্থী আরমান শহীদ, আনোয়ারা কলেজের নয়ন বিশ্বাস, ঢাকা মার্কস হসপিটালের ডেন্টাল স্পেশালিষ্ট রাজদীপ্ত সুশীল, চট্টগ্রাম সিটি কলেজের রাজিব আহমেদ, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক কলেজের অনিক রাজ অনিন, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজের ইমরান, সিটি কলেজের আসিক মির্জা ও বরমা ডিগ্রি কলেজের শিউলি বিশ্বাস । চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ম্যানেজমেন্ট ৪র্থ বর্ষের ছাত্র আরমান শহীদ বলেন, “সোলতানা সাদিয়া রিনা আপুর এমন মহৎ উদ্যোগের সাথে অংশীদার হতে পেরে আমি গর্বিত।” সোলতানা সাদিয়া রিনার কাছে ২য় শ্রেণী থেকে অদ্যাবদি প্রাইভেট পড়ছেন আনোয়ারা সরকারি কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী অনিক চৌধুরী। তিনিও সোলতানা সাদিয়ার স্বপ্ন পূরণের পাঠশালায় বিনা পয়সায় পড়াচ্ছেন। সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রাইভেট পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের মধ্যে রুম্পি বিশ্বাস, সাজু আক্তার, মুন্নী আক্তার, শিপু আক্তারের সাথে আলাপকালে তাঁরা বলেন, “সোলতানা সাদিয়ার এই মহতী উদ্যোগের কারনে এলাকার গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক উপকার হয়েছে। ছেলে মেয়েরা আগের চেয়ে বেশি মনোযোগী হয়েছে লেখাপড়ায়।” ভালো ফলাফলের জন্য বিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি প্রাইভেট পড়াতে হয় উল্লেখ করে তারা বলেন, “বর্তমান সময়ে একজন ছাত্রকে প্রাইভেট পড়াতে ৫০০/১০০০ টাকা দিতে হয়। শিক্ষা এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়ে নিজের স্বার্থ ছাড়া কেউ কোন কাজ করেনা কিন্তু সোলতানা সাদিয়া বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়ানোর মত যে মহত কাজটি করছে তা নিঃসন্দেহে সওয়াবের কাজ। এব্যাপারে সোলতানা সাদিয়া রিনার সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, “আমার স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হবো কিন্তু অভাব-অনটনের কারনে আমার সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল আমার এলাকার যে সকল হতদরিদ্র পরিবারের ছাত্র-ছাত্রী আছে, যারা টাকার অভাবে প্রাইভেট পড়তে পারেনা তাদেরকে বিনা পয়সায় পড়ানোর পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহযোগীতা করবো। আমার কাছে এক সময় প্রাইভেট পড়ে এখন বিভিন্ন কলেজে পড়ালেখা করছে এমন কয়েকজন তরুণ স্বেচ্ছাশ্রমে আমার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে বিনা পয়সায় দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছে দেখে খুবই ভালো লাগছে। আশা করি আমার প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এলাকা ও দেশের মূখ উজ্জ্বল করবে।” দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহযোগীতা করার জন্য বিত্তশালীদের প্রতি আহবান জানান তিনি। স্থানীয় ইউ.পি সদস্য মোস্তাফিজ মিয়া বলেন, “শুনেছি এখানে যারা প্রাইভেট পড়তে আসে তারে একেবারে হতদরিদ্র পরিবারের ছাত্র-ছাত্রী। স্কুলে বিনামূল্যে পড়ালেও বাড়িতে ভালোভাবে হোমওয়ার্ক না করলে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জণ করা কষ্টকর। মানসম্মত শিক্ষার অভাবে কোন ছাত্র-ছাত্রী যাতে ঝরে না পড়ে সে জন্য সোলতানা সাদিয়ার উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। বর্তমান সরকার শিক্ষার উপর যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিচ্ছে। এলাকার বিত্তশালী ব্যক্তিরা যদি একটু সহযোগীতার হাত বাড়ায় তাহলে স্বপ্ন পূরণের পাঠশালা আরো সমৃদ্ধ হবে। দরিদ্র পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য প্রত্যেক এলাকায় উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি। পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণ প্রদানের জন্য বিত্তশালীদের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি। সোলতানা সাদিয়া রিনা মায়ের গর্ভে থাকাবস্থায় তার বাবা ও মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় জন্মের পর থেকেই মায়ের সাথে নানা বাড়িতে থাকেন। মা ফুল বেগম সোলতানা সাদিয়া সহ অন্য তিন বোনকে পিতার অভাব বুঝতে দেননি। পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। চার বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সোলতানা সাদিয়ার অন্য তিন বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা স্বামীর বাড়ীতে অবস্থান করছেন। সোলতানা সাদিয়া রিনা জাফরাবাদ ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ২০০২ সালে ইবতেদায়ী ৫ম, ২০০৬ সালে দাখিল অষ্টম, ২০০৯ সালে দাখিল, ২০১১ সালে আলিম, ২০১৫ সালে ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৬ সালে বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করে জাফরাবাদ ফাজিল মাদ্রাসার আই.সি.টি প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালণ করছেন। অনলাইন ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘দোহাজারী ব্লাড ব্যাংক’ ও ‘বাঁশখালী ব্লাড ব্যাংক’ এর কার্যকরী সদস্য হিসেবে একাধিকবার স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন সোলতানা সাদিয়া। নিজ এলাকার তরুণ-তরুণীদের স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গড়ে তুলেছেন ‘মানবতা
/চাঁটগার সংবাদ!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ