দ্বীপ দিদারঃ
রচয়িতা মারা গেছে সৃজন বর্ষায়,
খুঁজেও পাবে না তাকে জলের বাসরে!...
জলের হৃদয়ে মিশে
চিনি
হলো ফানা!
মিশে
জলজ তরলে হলো গো সরলা!
হলো, আমা হতে তুমি— আমি, তুমিময়!...
বন্ধু,
আমি কি তোমাকে চিনি,
চিনির প্রকারে, চায়ের লিকারে?
বলো, কীভাবে মিশিবে তুমি চিনিফানাময়ে?
গঞ্জের দোকানে বসে শরবতি বানু
রসেবশে
গুলিতে গুলিতে চিনিফানা
দেখে,
ছেলেটির মেয়েটির
অপরূপ মেশামেশি, রসজ শরীরে মনজ দ্রবণ!...
এখানে
সবাই বন্ধু— আমিতুমিময়!
কী ভাবের তাপে
তুমি হবে গো আলাদা?
#চিনিফানা-আরণ্যক টিটো
.........................
চিনিফানা একধরনের শরবত, যার প্রধান উপাদান পানি ও চিনি। চিনিফানা সাধারণত চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি ঘরোয়া পানীয় হিসাবে পরিচিত। একসময় চট্টগ্রামে গৃহস্থের মেহমান আপ্যায়নের প্রথম ও প্রধান অনুষঙ্গ ছিল চিনিফানা। বহুবিধ দেশি-বিদেশি খাবার-দাবারের ছড়াছড়িতে স্বয়ং চট্টলার অনেক বাসিন্দাও হয়তো চিনিফানার নাম ভুলতে বসেছেন!? তবে এখনো চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা সমূহে চিনিফানার প্রচলন দেখা যায়। সাধারণত গরমের দিনেই মেহমান বরণের ক্ষেত্রে এবং নিয়মিত ঘরোয়া খাবার হিসাবে চিনিফানার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় বেশি। চিনিফানা শরবতের ব্যবহারের ব্যাপারটি ঐতিহাসিক কাল ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের পানিশূন্যতা বিষয়ক জ্ঞানেরও ইঙ্গিত বহন করে!?...চিনিফানা কিংবা এই সহজিয়া শরবতের গোড়ার কথা অনুসন্ধান করতে গেলে অবশ্যই বেরিয়ে আসবে আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়(......)। এ কথা সহজেই অনুমান করা যায় যে, ৭ম শতক থেকে বাংলায় আসা আরব নাবিক কিংবা এ সময় থেকে পরবর্তী নানান সময়ে আসা আরবের অথবা পারস্যের সুফি-দরবেশদের হাত দিয়েই এই চিনিফানা শরবতের (প্র)চলন হয় বাংলার উপকূলীয় অঞ্চল সমূহে!? হতে পারে, সুফি-দরবেশগণ সহজিয়া ইসলামের ভাতৃত্ববোধ দিয়ে যেমন এ জনপদের মানুষকে সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তির প্রেরণা দিয়েছেন, তেমনি চিনিফানা দিয়ে নিত্য মড়ক আক্রান্ত এ জনপদের মানুষকে দিয়েছিলেন পানিশূন্যতা থেকে মুক্তির প্রেরণা!?
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, চিনিফানা নিছক একটি শরবত/পানীয়/দ্রবণ।... চিনিফানা-- এখানে ফানা শব্দটি মাত্রই চিনির দ্রবণকে নির্দেশ করে। কিন্তু আদতে ফানা শব্দটির 'একাকার হওয়া', 'লীন হওয়া' এমন আরো বৃহদার্থেও ব্যবহার করে থাকেন সুফিরা। লোক সমাজে উন্মাদ, মজ্জুব, দিওয়ানা এমন কিছু মাস্তানা জাতীয় শব্দের সমার্থক হিসাবে ফানা শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।... তবে কি এই চিনিফানা প্রতীকের আড়ালে সুফিরা তাঁদের ফানাফিল্লাতত্ত্বের মতো নিগূঢ় আধ্যাত্মিক তত্ত্বও বিতরণ করে গেছেন এ জনপদে?! দেহের পানিশূন্যতা দূরীকরণের এই পানীয়ের মধ্য দিয়ে সুফিরা এখানকার মানুষকে আত্মার মুক্তির বার্তাও দিয়ে গেলেন?!
রচয়িতা মারা গেছে সৃজন- বর্ষায়
খুঁজেও পাবে না তাকে জলের বাসরে
এ পঙক্তিদ্বয় বা চরণে সাহিত্যের লেখকের মৃত্যু তত্ত্বের একপ্রকার সহজ ব্যাখ্যা মিলতে পারে!?...সংশ্লিষ্ট রচনা লেখা বা সৃষ্টির মুহূর্তেই লেখক রচয়িতা বা স্রষ্টা থাকেন, রচনা মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পর তার সে লেখক সত্তার মৃত্যু হয়। অর্থাৎ পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট রচনার লেখক নিজেও একজন পাঠক মাত্র। তবে কী রচনাকালীন মুহূর্তে লেখক/রচয়িতা কোনো বিশেষ সত্তা লাভ করেন?! তা সাহিত্যের পণ্ডিতগণই ভালো বলতে পারবেন, অথবা রচয়িতার মৃত্যু তত্ত্বের প্রবর্তক।
রচয়িতা মারা গেছে সৃজন- বর্ষায়
খুঁজেও পাবে না তাকে জলের বাসরে
এখানে রচয়িতা হতে পারে চিনিফানার মূল উপাদান--চিনি।
এখন এই দ্রবণ থেকে চিনির আলাদা সত্তা খুঁজে পাওয়া আর সম্ভব নয়। তাছাড়া চিনিফানায় ব্যবহৃত জলও আগের সে জল নাই; চিনিকে নিজের হৃদয়ে দ্রবীভূত করে জল হয়ে গেছে মিষ্ট জল/ভিন্ন এক যৌথসত্তা/একটি দ্রবণ।...এখন চিনিকে যদি পরমাত্মার রূপক আর চিনিফানাকে যদি আত্মার/জীবাত্মার রূপক ধরি, তবে এখানে আমরা ভগবত গীতার সৃষ্টিতত্ত্ব বা সুফি দর্শনের সৃষ্টিতত্ত্বের একপ্রকার নির্যাস পেতে পারি!?... পরমাত্মা যখন ইচ্ছা করলেন, সৃষ্টির মাঝে বিচিত্র রূপে লীন হয়ে গেলেন বা কুনফায়াকুন ইচ্ছা/উচ্চারণের মধ্য দিয়ে খোদা নিজেই সৃষ্টিতে পরিণত হয়ে গেলেন। অথবা আদম ছুরতের মাটির আধারে খোদার নূর প্রবেশ করায় আদমের প্রাণপ্রবাহে খোদা মিশে গেলেন। এখন যিনি নর তিনিই নারায়ণ, যিনি আদম তিনিই খোদা। অথবা যিনি নূর-এ মুহাম্মদী তিনিই নূর-এ খোদা; যা চিনিফানা তা-ই চিনি!?
এবার পরবর্তী চরণে নিখুঁতভাবে ফানাফিল্লা তত্ত্ব মিলবে চিনিফানা তৈরিপ্রণালীর ভিতর দিয়ে-- জলের হৃদয়ে মিশে চিনি হলো ফানা-- জলের অক্সিজেন, হাইড্রোজেনের সংস্পর্শে এসে চিনি জলে একাকার হলো। জলের তরল সত্তায় লীন হয়ে হয়ে চিনির কঠিন দানাদার সত্তা জলের মতো সরল রূপে রূপান্তরিত হলো।... এখানে চিনি হতে পারে মানবাত্মা যা তার জৈবিক প্রবণতা বা নফ্স সমূহকে/নিম্ন স্তরের আত্মাকে খোদার আদি প্রাণপ্রবাহের/রুহের অভিমুখী করে খোদার গুণে গুণান্বিত হচ্ছে-- খোদার সত্তায় নিজেকে লীন করে আকার থেকে হয়ে যাচ্ছে নিরাকার/নীরাকার/সরালা। এভাবে নিজের অহম/আমিত্বকে ত্যাগ করে প্রেমিক তার প্রেমাস্পদ খোদার পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে।...
হলো, আমা হতে তুমি--আমি তুমিময়
এ পঙক্তিতে আত্মবিলোপতাকে দেখা হচ্ছে ভিন্নভাবে--এখানে ১ম পুরুষ থেকে ২য় পুরুষের আবির্ভাব দেখানো হচ্ছে। আবার ১ম পুরুষই হচ্ছে ২য় পুরুষময়। অর্থাৎ ১ম পুরুষের বিলুপ্তি নয়, বরং ১ম পুরুষ কতৃক ২য় পুরুষকে ধারণ করে এক যৌথসত্তা অর্জনের কথাই ইঙ্গিত করছে!? হতে পারে এটি ব্যক্তিসত্তার সংকীর্ণ ধারণা থেকে যৌথ সামাজিক সত্তা অর্জনের ইঙ্গিতও
পূর্বের দু'টি চরণে এতক্ষণ আমরা কেবল চিনিফানার সাথে চিনির সম্পর্ক আর জীবাত্মা/মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার সম্পর্কের স্বরূপ দেখেছি। এর পরের চরণে চিনি বা জীবাত্মা/মানবাত্মার বিচিত্র রূপের ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। পাওয়া যেতে পারে জীবত্মার সাথে জীবাত্মার সম্পর্কের স্বরূপ--
বন্ধু
আমি তোমাকে চিনি,
চিনির প্রকারে, চায়ের লিকারে?
বলো, কী ভাবে মিশিবে তুমি চিনিফানাময়ে
এখানে বন্ধু বা অপর মানুষকে চিনির প্রকারে চেনার কথা বলা হচ্ছে। যে চিনি ফানাময়/দ্রবণীয় চায়ের লিকারে, অথবা আরো বিচিত্র রূপে বিরাজ করে খাবারে খাবারে।...জীবাত্মাকে যদি চিনির প্রকারে দেখা হয়, তবে মানবত্মা হোক আর জীবাত্মা হোক সবকিছুতে বিচিত্র রূপ ধারণ করে আছে পরমাত্মার আদি প্রাণপ্রবাহ। নারী, পুরুষ, কালো, ধলা, ধনী, গরীব সবার মধ্যেই মানবাত্মা হয়ে আছে সেই আদি প্রাণপ্রবাহ। শুধু কি মানুষ, ব্রমাণ্ডের নানান কিছিমের জীব ও জড়ের মধ্যেও নানানভাবে নানান অবস্থায় প্রবাহিত সেই আদি প্রাণপ্রাবহের ধারা। যেটুকু অমিল তা কেবল রূপের আর আমাদের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার!?
এবার অতি সাধারণ ও পরিচিত একটি চিত্রকল্পনা, যাতে মানবের সাথে মানবের সম্পর্ককে দেখা হচ্ছে অধিবিদ্যক সহজতা থেকে-- গঞ্জের দোকানে বসে শরবতি বানু রসে বশে গুলিতে গুলিতে চিনিফানা দেখে, ছেলেটির মেয়েটির অপরূপ মেশামেশি, রসজ শরীরে মনজ দ্রবণ!...এখানে শরবতী বানু হতে পারে স্বয়ং পরমাত্মার প্রতীক অথবা ভগবতী/প্রকৃতি যে চিনিফানা গুলিতে গুলিতে/সৃষ্টির লীলা করতে করতে ছেলে/চিৎশক্তি/আত্মা আর মেয়ে/আধার/জৈব/জড় সত্তার অধিবিদ্যক মিশামিশি দেখছে। রসজ শরীরের সাথে মনজ দ্রবণ/ বস্তুসত্তার সাথে চিৎশক্তির/প্রাণপ্রবাহের আজব সমন্বয়!?...না, তা হয়তো নয়। এখানে নারী-পুরুষের আদিম ধ্রুপদী সম্পর্ককে ইঙ্গিত করার জন্যই হয়তো এই চিত্রকল্প বা শরবতী বানুর অবতারণা। তবে এখানে রসজ শরীরে মনজ দ্রবণ বলতে নারী-পুরুষের সম্পর্ককে কেবল কাম বা স্বার্থের জায়গা থেকে নয়, দেখা হয়েছে আরো মহান মানসজাত পরমার্থিক মিলনের প্রেক্ষাপট থেকে।...সম্প্রতি আমরা মানুষকে রক্ত মাংসের তৈরি নিছক এক যন্ত্র হিসাবে বিবেচনা করছি। মানবের সাথে মানবের কিংবা নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্ককে কেবল স্বার্থ বা কামনার জায়গা থেকে বিবেচনা করতে আগ্রহী। শরীরী উত্তেজনাময় মুহূর্তভিত্তিক ক্ষণবাদী প্রেমের বস্তুবাদী ভাষ্য দাঁড় করাচ্ছি। কিন্তু তবুও স্বার্থ-কামনার ঊর্ধ্বেও কি মানুষ ছুটছে না মানুষের পানে, নারী ছুটছে না পুরুষের টানে কিংবা পুরুষ নারীর টানে?!
মানুষের অস্তিত্বজাত কামনা ও স্বার্থের অমোঘ প্ররোচনায় মানুষ মানুষের সাথে যেমন দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত হয় তেমনি মানুষের সাথে মানুষ মিলিত হয় চাহিদা পুরণের যৌথ সাধনায়। কিন্তু এরপরেও মানুষের প্রতি মানুষের আছে এক ঐন্দ্রজালিক টান, প্রসারিত থাকে মানুষের প্রতি মানুষের পরমার্থিক চাহিদা রেখা।... মানুষের দৈহিক বিকাশের সাথে সাথে তার সমাজ-সম্পর্ক যেমন বিকশিত হয়েছে তেমনি তার ভিতর বিকশিত হয়েছে/হচ্ছে মায়া মমতা স্নেহ, যার মধ্য দিয়ে আদি প্রাণপ্রবাহকে/সকল প্রাণের নিরবিচ্ছিন্ন রূপকে অনুভব করছে অপর মানুষে। আর সেই নিরবিচ্ছিন্নতাবোধসম্পন্ন আত্মীয়তা বা কোনো সম্পর্কের টান যত দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে মানুষ তত দূরকে জেনেছে নিজের অস্তিত্ব বলে!?
তাই মানুষ ব্যথিত হয় মানুষের ব্যথায়। এভাবে মানুষের নানান আচরনের মধ্য দিয়ে দিয়ে প্রকাশিত হয় এক সাধারণ প্রবণতা যা সর্ব মানবেরই দ্রবণীয়/মিলন প্রয়াসী গুণ। সাকার বিশিষ্ট সর্ব মানবের ভেতর আছে এক নিরাকার রূপ যা আকার বা অস্তিত্ব জনিত দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মিলন-সংঘের ঊর্ধ্বে। যা চিনিফানার চিনির মতো মিশে আছে বিচিত্র মানুষের মাঝে। সেই আদি প্রাণের চিরন্তন মিলনমুখিতা হয়ে মানুষকে টানছে মানুষের পানে!?
এখানে
সবাই বন্ধু--আমি তুমিময়!
কী ভাবের তাপে
তুমি হবে গো আলাদা?
এই নিত্য বিকশিত জগৎ-সংসারে অভিন্ন প্রাণের বন্ধন বহনকারী সবাই আমরা বন্ধু!? সবাই আমরা বহন করে চলছি এক অবিচ্ছিন্ন প্রাণপ্রবাহ!? অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণ মিলে আমরা বিকশিত করে চলছি এক মহাপ্রাণকে!? জলে দ্রবীভূত চিনির মতো একটি প্রাণই আমাদের মাঝে নানান পাত্রে/শরীরে, আকারে, প্রকারে দ্রবীভূত আছে!? আমাদের দৃষ্টিতে যতোই আলাদা দেখাক, আদতে কোনো জন্মে-মৃত্যুতে কেউ আমরা আলাদা হই না কখনোই।
0 মন্তব্যসমূহ