মোঃ বেলাল উদ্দিনঃ
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মধ্য ইলশায় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী বখশী হামিদ মসজিদ। ইসলাম ধর্মের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক। ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশে তৎকালীন সময়ে এই মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুসলিম শিক্ষা-সংস্কৃতির ভিত রচনা করে এ মসজিদ। মসজিদে রক্ষিত ফলকে আরবিতে লেখা আছে “বনাল মাসজিদুল মোকারেম ফি আহমিদ-মূলক, ইসনাদুল মিল্লাত ওয়াদ্দিন সুলতানুল মুয়াজ্জাম সুলাইমান। সাল্লামাল্লাহু আনিল ওয়াফাত ওয়াল বলিয়্যাতি মুরেখাত তিসযু রমজান, খামছুন ও সাবয়িনা ওয়া তিসআতু মিআত হিজরী আলাইহিস সালাম।” অর্থাৎ এই মসজিদ নির্মিত হয়েছে সেই বাদশাহ্ যুগে যাকে উপাধি দেয়া হয়েছে দ্বীন এবং মিল্লাতের সুলতানুল মুয়াজ্জম-তথা মহান সম্রাট। আর তিনি হলেন সুলায়মান কররানী, (আল্লাহ তাকে বিপদাপদ থেকে মুক্ত রাখুন) তারিখ লেখা আছে ৯৭৫ হিজরী সালের ৯ রমজান। যার ইংরেজি সন ১৫৬৮ সালের ৯ মার্চের সাথে মিলে যায়।
শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এটি সুলাইমান কররানী কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও; লোকমুখে বখশী হামিদের নির্মিত মসজিদ বলে পরিচিত।
স্থানীয় মুরব্বীরা জানান, বখশী হামিদের পুরো নাম মুহাম্মদ আবদুল হামিদ। 'বখশী' হচ্ছে তার উপাধি। 'বখশী' ফার্সি শব্দ। এর অর্থ কালেক্টর বা করগ্রহীতা। তৎকালীন সময়ে বখশী হামিদ এতদাঞ্চলের কালেক্টর তথা প্রশাসক ছিলেন। তিনি এলাকার শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। জনশ্রুতি অনুসারে তৎকালীন এ এলাকায় প্যারাবন ছিল। ঝোঁপঝাড়ে জনবসতি ছিল না। ইউসুফ ও কুতুব নামে গৌড়ের দুজন আমির শাহ আবদুল করিম নামক জনৈক সুফীর সঙ্গে গৌড় ছেলে উপযুক্ত বাসস্থানের সন্ধানে বঙ্গোপসাগরে পাড়ি দিয়ে বাঁশখালীর এ জায়গা অবতরণ করেন। তারা উপকরণ নিয়ে বাঁশখালীর ইলশার দরগা বাড়ির স্থানে পৌঁছলে শাহ সাহেব ইল্লাল্লাহ শব্দ উচ্চারণ করে তার ছড়ি পুঁতে রাখেন এবং সেখানে বসবাসের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এ সময় থেকে স্থানটি ইল্লাল্লাহ শাহের স্থান এবং পরে ইলশায় রূপান্তরিত হয়।
বখশী আবদুল হামিদ উক্ত শাহ শাহের অধস্তন বংশধর। কেউ কেউ মনে করেন গৌড় থেকে আগত সুফী দরবেশের মধ্যে একজন ছিলেন সুলাইমান। তিনি নেতৃস্থানীয় সাধকও ছিলেন। জ্ঞানে গুনে প্রভাবশালী ছিলেন। সবাই তাকে সুলতান বলে ডাকত। তিনি এ মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন এবং পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পর মুরব্বীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে একমাত্র কন্যাটি বাঁশখালী উপজেলার জলদী গ্রামে বিয়ে দেয়া হয়। তার দুই ভাই ছিল। সেখানে মাটি খুঁড়লে এখনও প্রাচীন সভ্যতার নির্দশন খুঁজে পাওয়া যায়। অলি বুজুর্গের আবাদকৃত এ গ্রামে বহু দ্বীনদার পীর মাশায়েখের আবির্ভাব হয়েছিল। তৎমধ্যে শাহ চান মোল্লা অন্যতম। তিনি এ মসজিদ নির্মাণের সমসাময়িক যুগের বলে অনেকের ধারণা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে এটি প্রটেকটেড মনুমেন্ট অ্যান্ড মৌন্ডস ইন বাংলাদেশ-এর তালিকায় স্থান পাওয়ায় আংশিক সংস্কার হয়েছে। মোঘল স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত এ মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মাঝখানের গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং ছোট গম্বুজ দুটি ধনুকের মতো করে ছাদের সঙ্গে যুক্ত। ৪৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বখশি হামিদ মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল ইসলামি কমপ্লেক্স। এ কমপ্লেক্সের নাম রাখা হয়েছে দারুল কোরআন মুহাম্মদিয়া শাহ বখশি হামিদ কমপ্লেক্স। এই কমপ্লেক্স থেকে কোরআন শিক্ষা নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে অনেকে দ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছেন।
মোঘল স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত এ মসজিদ দর্শন করতে চাইলে প্রথমে আসতে হবে বাঁশখালীর গুনাগরী খাসমহল বাজারে। বাজার থেকে সোজা পশ্চিমে অবস্থিত এ মসজিদ। ইতিমধ্যে ঐতিহাসিক এই মসজিদটি পরিদর্শনে আসেন গবেষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
এদিকে ঐতিহ্যমন্ডিত এ স্থাপনায় প্রবেশের রাস্তাটি আরো প্রশস্ত করার প্রয়োজন মনে করেন সচেতন মহল।
0 মন্তব্যসমূহ