জুবাইর চৌধুরী, বিশেষ সংবাদদাতাঃ
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় সদ্য নির্মিত বেড়িবাঁধের ব্লক গুলো ধ্বসে পড়তে শুরু করেছে। উপকূলের অনেকাংশে এখনো কাজ না হওয়ায় অনেকটা অরক্ষিত হয়ে পড়ে আছে। যেটুকু অংশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে ওই কাজের মান নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বর্তমানে ব্লক ধ্বসে পড়ায় তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। অরক্ষিত বেড়িবাঁধের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের আবাস পেলেই নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে উপকূলীয় লোকজন। বাঁশখালীর উপকূলে প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগে বিপুল পরিমাণ প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির ফলে বাঁশখালীর সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উপকূলীয় জনগণকে দুর্যোগের হাত রক্ষার্থে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই এলাকায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ প্রদান করেন। সেই লক্ষ্যে একনেকে ২৫১ কোটি ২৯ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকার অনুমোদন দেয় সরকার। এরমধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৯০ কোটি টাকা ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২০ কোটি টাকার মধ্যে এ পর্যন্ত ৩০ কোটি টাকা ছাড় দেয়া হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় আবারো বাড়লে তা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের বাঁশখালীতে অফিস ও বাসভবন থাকলেও সেখানে তাদের অনুপস্থিতি নিত্যনৈমিত্য ব্যাপার। তাছাড়া তাদের গাফিলতিতে চলমান বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজে নিয়োগকৃত ঠিকাদারদের কাজের ব্যাপক অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে উপকূলবাসী। শুধু নামমাত্র ঠিকাদার কর্তৃক প্রদত্ত গাড়ীতে এসে আবার পুনরায় গাড়িতে করে চলে যায় পাউবো কর্মকর্তারা। ঠিকাদারদের সাথে কর্মকর্তাদের সুসম্পর্কের সুযোগ নিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে চলছে ব্যাপক অনিয়ম।
স্থানীয়দের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (১১ নভেম্বর) খানখানাবাদে নির্মিত বেড়িবাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, নির্মিতব্য বেড়িবাঁধে নি¤œাংশে প্রায় ব্লক ধ্বসে পড়তে শুরু করেছে। স্থানীয়দের সাথে কথা হলে তারা জানান, বেড়িবাঁধের ব্লকে যে বালি ব্যবহার করা হয়েছে তা অত্যন্ত নি¤œমানের। ব্লকে যে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তাও নি¤œমানের। তাছাড়া বেড়িবাঁধ নির্মাণে মাটি ব্যবহার করা হয়েছে সাগর থেকেই। যথাযথ ভাবে রোলার দ্বারা চাপ না দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করায় বসানো ব্লক গুলো অতিশয় ধ্বসে পড়তে শুরু করেছে। খানখানাবাদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিক আবু জানান, উপকূলবাসীর একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন স্বপ্নের বেড়িবাঁধ নির্মাণে সম্পূর্ণ নয়ছয় করা হয়েছে। যার ফলে বাঁধের ব্লক গুলো ধ্বসে পড়তে শুরু করেছে। এই বেড়িবাঁধ দিয়ে কি হবে। উপকূলবাসীর আতংক থেকেই গেছে।
পরিদর্শনকালে দেখা যায়, খানখানাবাদ, কদমরসুল ও প্রেমাশিয়ার কিছু অংশে বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। খানখানাবাদ অংশে বাঁধের মাটির কাজ চললেও যে স্থানে ব্লক বসানো হয়েছে ইতিমধ্যে তা ধ্বসে পড়তে শুরু করেছে। বাহারছড়ায় ব্লক বসানো হলেও তা জোয়ারের পানিতে কিছু অংশে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পুকুরিয়া অংশে শঙ্খ নদীর ভাঙন এলাকায় ব্লক বানানোর কাজ চলছে। সাধনপুরে মাটির কাজ শেষে ব্লক বসানোর কাজ চলছে। গন্ডামারায় মাটির কাজ শেষে এখন ব্লক বসানোর জন্য বাঁধ উপযোগী করা হচ্ছে। ছনুয়ায় ঠিকাদার কাজ বন্ধ রাখায় এই এলাকা অরক্ষিত রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বাঁশখালী উপজেলার খানখানাবাদ, বাহারছড়া, গন্ডামারা, ছনুয়া ও সাধনপুর এলাকায় পোল্ডার নং-৬৪/১এ, ৬৪/১বি এবং ৬৪/১সি এ বাঁধ নির্মাণের টেন্ডার আহবান করা হয়। ২০১৫ সালের ১ মে শুরু হয়ে কাজের মেয়াদ ছিল ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় মেয়াদ পুনরায় বাড়িয়ে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। নির্মাণ কাজের মধ্যে ছিল ঢাল সংরক্ষণসহ ৯.৯০০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, ৩.৮৪৮ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণ, ২ কিলোমিটার বাঁধ পুনরাবৃত্তিকরণ। ৩৪টি প্যাকেজের মধ্যে এই কাজের ঠিকাদারী পায় হাছান এন্ড ব্রাদার্স ২০টি প্যাকেজ, মেসার্স মশিউর রহমান ৮টি প্যাকেজ, মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজ ২টি প্যাকেজ, মোস্তফা এন্ডসন্স ২টি প্যাকেজ, নিয়াজ ট্রেডার্স ১টি প্যাকেজ, আলম এন্ড ব্রাদার্স ১টি প্যাকেজ। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে খানখানাবাদে চার হাজার ৫০০ মিটার, ছনুয়ায় তিন হাজার ২০০ মিটার, সাধনপুরে দুই হাজার ৭৯ মিটার, পুকুরিয়ায় এক হাজার ২৬৯ মিটার, গন্ডামারায় ৯০০ মিটার কাজ চলমান আছে।
উল্লেখ্য, বাঁশখালীর উপজেলার উপকূলীয় খানখানাবাদ, গন্ডামারা, বাহারছড়া ও ছনুয়ায় বিগত দিনে একের পর এক বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছাসে বিপুল পরিমাণ লোকজনের প্রাণ হানি হয়। ঘর বাড়ি ও গৃহপালিত পশুসহ সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে আরো অনেকে। দুর্যোগ থেকে বাঁচতে উপকূলবাসীদের অনেকেই ইতিমধ্যে বসতভিটি ও জায়গা জমি বিক্রি করে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে। এরই মধ্যে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ায় উপকূলবাসীরা বেঁচে থাকার কিছুটা অবলম্বন খুঁজে পায়। কিন্তু আশার সেই বেড়িবাঁধেই দেখা দেয় ধোঁয়াশা। ফলে আবারো জীবন মরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে উপকূলীবাসীর।
বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজের ব্যাপক অনিয়মের বিষয়ে পাউবো চট্টগ্রামের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহেরের কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাঁশখালীর কয়েকটি ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের কাজ চলমান রয়েছে। ঠিকাদারের কাজের অনিয়ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন আমি চট্টগ্রাম শহরে অফিসে রয়েছি। বিস্তারিত জানতে অফিসে আসুন।
এ বিষয়ে জানতে পাউবো’র চট্টগ্রামের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অপু দেবের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
0 মন্তব্যসমূহ