মুহাম্মদ মহিউদ্দিন, বিশেষ সংবাদদাতাঃ
বাশঁখালী আনোয়ারা উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ এখনো সুরক্ষিত নয়। তাই ঘূর্ণিঝড় এলেই মানুষের বেড়ে যায় ভয়। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পর আকাশে মেঘ জমলে ভয়-আতঙ্ক তাড়া করে উপকূলীয় এলাকার মানুষজনকে। দুই উপজেলার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সুরক্ষায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে বছরের পর বছর যায়। কিন্তু বেড়িবাঁধ সুরক্ষিত হয় না। ব্লক দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সুরক্ষার দৃশ্য দেখতে সরেজমিন উপকূলীয় এলাকায় যান আমাদের বাশঁখালী ও আনোয়ারা প্রতিনিধি। তাঁদের পাঠানো তথ্য মতে, বেড়িবাঁধ নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার ছাপ নেই কোথাও। এ কারণে বেড়িবাঁধে লাগানো ব্লক এবড়োথেবড়ো হয়ে পড়ে আছে। কোথাও নেই ব্লক। আবার কোথাও ব্লকের উপরের অংশে রয়েছে বালির বস্তার রাজত্ব। এসব বাঁধ র্নিমাণ ও সুরক্ষায় নানা অনিয়মের কথাও উঠে আসে বিভিন্ন সময়।
বাশঁখালী প্রতিনিধি জানান, প্রকল্প গ্রহণের পর যে সব এলাকায় বেড়িবাঁধ খোলা রয়েছে তার অনেক স্থানে এখনো কাজ করা হয়নি। ফলে সেসব উপকূলীয় এলাকার জনগণের ঘুম হারাম হয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়ের কথা শুনলেই। বাশঁখালী উপকূলের বাসিন্দাদের রক্ষায় স্বপ্নের বেড়িবাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নে বার বার সময় ক্ষেপণের ফলে যে আশা নিয়ে এ কাজটি শুরু হয়েছে তা অনেকটা ম্লান হতে বসেছে । কাজের সমন্বয় ও ধারাবাহিকতা না থাকায় বেড়িবাঁধের একদিকের কাজ শেষ হতে না হতে অপরদিকে খসে পড়ছে ব্লকের আস্তরণ। সরে যাচ্ছে ব্লক। প্রকল্পের কাজের ধীর গতির কারণে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছে উপকূলের জনগণ । বাঁধের কাজ নির্দিষ্ট মেয়াদে শেষ করতে না পারা ও অনিয়মের কারণে ছনুয়া অংশের কাজের জন্য হাছান এন্ড ব্রাদার্সকে কেন্দ্র করে মামলা হলে তারা হাইকোর্টে রিট করে বসে। সেই কাজ এখনো শুরু করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বাশঁখালীর জনগণের দীর্ঘদিনের দাবির কথা মাথায় রেখে স্থানীয় সাংসদ আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর প্রচেষ্টায় গ্রহণ করা হয় এ প্রকল্প। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ২০১৩ সালে বাঁধের নকশা চূড়ান্ত করার পর প্রাথমিকভাবে ২০৯ কোটি টাকা বরাদ্দের বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ সালে বরাদ্দ বাড়িয়ে বাঁধ নির্মাণে ২৫১ কোটি ২৯ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকার অনুমোদন দেয় সরকার। এরমধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৯০ কোটি
ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২০ কোটি টাকার মধ্যে এ পর্যন্ত ৩০ কোটি টাকা ছাড় দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ২৮১ কোটি বাজেট ধরা হয় । পরবর্তীতে ডাম্পিং এর জন্য আরো ২২ কোটি টাকা যোগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সবমিলে ৩০৩ কোটির টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ চলছে বছরের পর বছর ধরে।
পাউবো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাঁশখালী উপজেলার পোল্ডার নং-৬৪/১এ, ৬৪/১বি এবং ৬৪/১সি এর সমন্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার পর ২০১৫ সালের ১ মে থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়। ঢাল সংরক্ষণসহ বাঁধ নির্মাণ ৯. ৯০০ কিলোমিটার, নদী তীর সংরক্ষণ কাজ ৩.৮৪৮ কিলোমিটার, বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ ২ কিলোমিটার প্রকল্পের আওতা ধরা হয়। ৩৪ প্যাকেজে কাজ শুরু করে ঠিকাদার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হাছান এন্ড ব্রাদার্স ২০টি প্যাকেজ, মেসার্স মশিউর রহমান আটটি প্যাকেজ, মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজ দুটি প্যাকেজ, মোস্তফা এন্ডসন্স দুটি প্যাকেজ, নিয়াজ ট্রেডার্স একটি প্যাকেজ, আলম এন্ড ব্রাদার্স একটি প্যাকেজের কার্যাদেশ পায়। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে খানখানাবাদে চার হাজার ৫০০ মিটার, ছনুয়ায় তিন হাজার ২০০ মিটার, সাধনপুরে দুই হাজার ৭৯ মিটার, পুকুরিয়ায় এক হাজার ২৬৯ মিটার, গন্ডামারায় ৯০০ মিটার বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের আওতায় ঢাল সংরক্ষণসহ বাঁধ নির্মাণ এবং নদী তীর সংরক্ষণের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়, জলোচছ্বাস, বন্যা ও সমুদ্রের লোনা পানির প্রবেশ ও নদী ভাঙন রোধ করতে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জানমাল ও ফসলহানি হ্রাসে বন্যার মাত্রা কমাতে নিষ্কাশন ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নেও প্রকল্পটি সহায়ক হবে। উপকৃত হবে বাশঁখালীর জনগণ। কিন্ত ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারনে জনগণকে রক্ষায় নেয়া বর্তমান সরকারের বিশাল এ প্রকল্প অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। বাঁশখালীর বেড়িবাঁধ নির্মাণে প্রকল্পের মেয়াদ আছে ছয় মাস। তার আগেই খানখানাবাদ অংশের নকশা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাউবো। নকশা অনুমোদন হলে প্রকল্পের ব্যয় আরো একদফা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রকল্পের বিষয়ে উপকূলীয় ছনুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম হারুনুর রশিদ জানান, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কারণে এলাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে । মামলা হয়েছে, হাইকোর্টে রিট হয়েছে। কবে কাজ শুরু হবে জানি না । ঘূর্ণিঝড়ের কথা শুনলেই এলাকার জনগণের ঘুম হারাম হয়ে যায় বলেও জানান এ চেয়ারম্যান। গন্ডামারার চেয়ারম্যান এম লিয়াকত আলী জানান, আমার এলাকায় দুর্যোগে জনগণকে সচেতন করার সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে । তবে বাঁধ সর্বত্র সম্পন্ন হলে জনগণ সুফল পেত ।
খানখানাবাদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ বদরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমার এলাকায় বাঁধের কাজ শেষ পর্যায়ে। ফলে এলাকার জনগণ নিরাপদে রয়েছে । তবে ডাম্পিং ব্লকগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। সেগুলো ঠিক করে দেয়া হবে বলেও তিনি জানান । প্রকল্পের প্রথমদিকে ডাম্পিং এর জন্য বরাদ্দ্ রাখা না হলেও পরে ২২ কোটি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে । বাহারছড়ার চেয়ারম্যান এম তাজুল ইসলাম বলেন, বেড়িবাঁধের বাহারছড়া অংশের কাজ এখনো শেষ হয়নি । ফলে যে সব ব্লক এখানে এলোমেলো আছে তা যথাযথভাবে বসানো হবে।
সরেজমিন দেখা যায়, খানখানাবাদ অংশের কদমরসুল ও প্রেমাশিয়া অংশে বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। খানখানাবাদ অংশে বাঁধে মাটির কাজ চলছে। বাহারছড়ায় ব্লক বসানো হলেও তা জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুকুরিয়া অংশে শঙ্খ নদীর ভাঙন এলাকায় ব্লক বানানোর কাজ চলছে। সাধনপুরে মাটির কাজ শেষে ব্লক বসানোর কাজ চলছে। গন্ডামারায় মাটির কাজ শেষে এখন ব্লক বসানোর জন্য বাঁধ উপযোগী করা হচ্ছে। ছনুয়ায় আইনী ঝামেলায় ঠিকাদার কাজ বন্ধ রেখেছে। তবে বাঁধ নির্মাণে নানা ধরনের অনিয়ম অভিযোগ করেন উপকূলীয় এলাকার লোকজন।
এ বিষয়ে পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাঁধের কাজ করা যাচেছ না। জোয়ারে পানি প্রতিনিয়ত বাঁধে আঘাত হানায় ছনুয়া, খানাখানাবাদ এলাকায় কাজ করা যাচ্ছে না। ঠিকাদারের অনিয়মের প্রমাণ পেলেই টাস্কফোর্স সরাসরি কাজ বন্ধ করে দেবে। আমরা দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য ঠিকদারদের চিঠি দিয়েছি। ২০২০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন এ কর্মকর্তা।
আনোয়ারা প্রতিনিধি জানান, আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপকূলীয় এলাকার মানুষজনকে রক্ষায় ২৮০ কোটি ৩০ লাখ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পাউবো। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দুই উপজেলার ২ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে বলে জানান পাউবো’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের নানা অনিয়ম-অবহেলায় সময় মত মাটির কাজ , ব্লক ডাম্পিং শেষ হয়নি। উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধের বেহাল দশায় চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে আনোয়ারা উপকূলকে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এ কারণে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবেলায় বাড়তি প্রস্তুতির পাশাপাশি শংকাও থাকছে বলে এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
উপকূলীয় ইউনিয়ন রায়পুর, জুঁইদন্ডি, বারশত, বরুমচড়া, বারখাইন ইউনিয়ন ও আনোয়ারার (কর্ণফুলীসহ) নিম্নাঞ্চলের দুই লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে ।ইউনিয়নের বার আউলিয়া ও জুঁইদন্ডি ইউনিয়নের ২,৪,ও ৫ নং ওয়ার্ডে বেড়িবাঁধ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া বদলপুরা থেকে জুঁইদন্ডি পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ বেড়িবাঁধের বাইরে চরম ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
জানা গেছে , আনোয়ারার উপকূলীয় এলাকা রায়পুর, গহিরা, সরেঙ্গা, দক্ষিণ গহিরা, চুন্নাপাড়া, জুঁইদন্ডি, খুরুশকুল, পারকী ও বারশত এলাকার মানুষ ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। অনেকই বাড়িঘর ছেড়ে নিকটাত্মীয় ও নিরাপদ স্থানে চলে গেছে। রায়পুর ইউনিয়নের রেডক্রিসেন্ট কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল সোহান জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করলেও অধিকাংশ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে যেতে চাই না।
এ বিষয়ে রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানে আলম জানান, ইউনিয়নের অর্ধলক্ষ মানুষ ঝুঁকিতে বসবাস করছে। ঘূর্ণিঝড় আসলেই ব্যপক ক্ষতি সাধন হবে অত্র জনপদের বাসিন্দারা । জুইদন্ডির চেয়ারম্যান মোরশেদুল আলম খোকা জানান, ঠিকাদারের নানা অনিয়ম ও অবহেলায় সময়মত বেড়িবাঁধের মাটির কাজ ও ব্লক ডাম্পিং না করার কারণে ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ড অরক্ষিত আছে। ঝুঁকিতে বসবাস করছে ৩০ হাজার মানুষ।
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ জোবায়ের আহমদ জানান, চট্টগ্রামে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আনোয়ারা ও বাশঁখালী উপকূল।
উপকূল রক্ষায় সরকারের গৃহীত বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের ২৮০ কোটি ৩০ লাখ টাকার প্রকল্পে ২৫০ কোটি টাকার কাজ হবে আনোয়ারায়। বাকী কাজ হবে কর্ণফুলী উপজেলায়। ২০২০ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু যেভাবে কাজ চলছে তাতে অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়ের কথা শুনলেই উপকূলের মানুষের মনে ধরে ভয় ও আতঙ্ক এমনটিই জানালেন সংশ্লিষ্টরা
বাশঁখালী আনোয়ারা উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ এখনো সুরক্ষিত নয়। তাই ঘূর্ণিঝড় এলেই মানুষের বেড়ে যায় ভয়। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পর আকাশে মেঘ জমলে ভয়-আতঙ্ক তাড়া করে উপকূলীয় এলাকার মানুষজনকে। দুই উপজেলার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সুরক্ষায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে বছরের পর বছর যায়। কিন্তু বেড়িবাঁধ সুরক্ষিত হয় না। ব্লক দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সুরক্ষার দৃশ্য দেখতে সরেজমিন উপকূলীয় এলাকায় যান আমাদের বাশঁখালী ও আনোয়ারা প্রতিনিধি। তাঁদের পাঠানো তথ্য মতে, বেড়িবাঁধ নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার ছাপ নেই কোথাও। এ কারণে বেড়িবাঁধে লাগানো ব্লক এবড়োথেবড়ো হয়ে পড়ে আছে। কোথাও নেই ব্লক। আবার কোথাও ব্লকের উপরের অংশে রয়েছে বালির বস্তার রাজত্ব। এসব বাঁধ র্নিমাণ ও সুরক্ষায় নানা অনিয়মের কথাও উঠে আসে বিভিন্ন সময়।
বাশঁখালী প্রতিনিধি জানান, প্রকল্প গ্রহণের পর যে সব এলাকায় বেড়িবাঁধ খোলা রয়েছে তার অনেক স্থানে এখনো কাজ করা হয়নি। ফলে সেসব উপকূলীয় এলাকার জনগণের ঘুম হারাম হয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়ের কথা শুনলেই। বাশঁখালী উপকূলের বাসিন্দাদের রক্ষায় স্বপ্নের বেড়িবাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নে বার বার সময় ক্ষেপণের ফলে যে আশা নিয়ে এ কাজটি শুরু হয়েছে তা অনেকটা ম্লান হতে বসেছে । কাজের সমন্বয় ও ধারাবাহিকতা না থাকায় বেড়িবাঁধের একদিকের কাজ শেষ হতে না হতে অপরদিকে খসে পড়ছে ব্লকের আস্তরণ। সরে যাচ্ছে ব্লক। প্রকল্পের কাজের ধীর গতির কারণে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছে উপকূলের জনগণ । বাঁধের কাজ নির্দিষ্ট মেয়াদে শেষ করতে না পারা ও অনিয়মের কারণে ছনুয়া অংশের কাজের জন্য হাছান এন্ড ব্রাদার্সকে কেন্দ্র করে মামলা হলে তারা হাইকোর্টে রিট করে বসে। সেই কাজ এখনো শুরু করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বাশঁখালীর জনগণের দীর্ঘদিনের দাবির কথা মাথায় রেখে স্থানীয় সাংসদ আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর প্রচেষ্টায় গ্রহণ করা হয় এ প্রকল্প। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ২০১৩ সালে বাঁধের নকশা চূড়ান্ত করার পর প্রাথমিকভাবে ২০৯ কোটি টাকা বরাদ্দের বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ সালে বরাদ্দ বাড়িয়ে বাঁধ নির্মাণে ২৫১ কোটি ২৯ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকার অনুমোদন দেয় সরকার। এরমধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৯০ কোটি
ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২০ কোটি টাকার মধ্যে এ পর্যন্ত ৩০ কোটি টাকা ছাড় দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ২৮১ কোটি বাজেট ধরা হয় । পরবর্তীতে ডাম্পিং এর জন্য আরো ২২ কোটি টাকা যোগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সবমিলে ৩০৩ কোটির টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ চলছে বছরের পর বছর ধরে।
পাউবো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাঁশখালী উপজেলার পোল্ডার নং-৬৪/১এ, ৬৪/১বি এবং ৬৪/১সি এর সমন্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার পর ২০১৫ সালের ১ মে থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়। ঢাল সংরক্ষণসহ বাঁধ নির্মাণ ৯. ৯০০ কিলোমিটার, নদী তীর সংরক্ষণ কাজ ৩.৮৪৮ কিলোমিটার, বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ ২ কিলোমিটার প্রকল্পের আওতা ধরা হয়। ৩৪ প্যাকেজে কাজ শুরু করে ঠিকাদার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হাছান এন্ড ব্রাদার্স ২০টি প্যাকেজ, মেসার্স মশিউর রহমান আটটি প্যাকেজ, মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজ দুটি প্যাকেজ, মোস্তফা এন্ডসন্স দুটি প্যাকেজ, নিয়াজ ট্রেডার্স একটি প্যাকেজ, আলম এন্ড ব্রাদার্স একটি প্যাকেজের কার্যাদেশ পায়। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে খানখানাবাদে চার হাজার ৫০০ মিটার, ছনুয়ায় তিন হাজার ২০০ মিটার, সাধনপুরে দুই হাজার ৭৯ মিটার, পুকুরিয়ায় এক হাজার ২৬৯ মিটার, গন্ডামারায় ৯০০ মিটার বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের আওতায় ঢাল সংরক্ষণসহ বাঁধ নির্মাণ এবং নদী তীর সংরক্ষণের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়, জলোচছ্বাস, বন্যা ও সমুদ্রের লোনা পানির প্রবেশ ও নদী ভাঙন রোধ করতে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জানমাল ও ফসলহানি হ্রাসে বন্যার মাত্রা কমাতে নিষ্কাশন ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নেও প্রকল্পটি সহায়ক হবে। উপকৃত হবে বাশঁখালীর জনগণ। কিন্ত ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারনে জনগণকে রক্ষায় নেয়া বর্তমান সরকারের বিশাল এ প্রকল্প অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। বাঁশখালীর বেড়িবাঁধ নির্মাণে প্রকল্পের মেয়াদ আছে ছয় মাস। তার আগেই খানখানাবাদ অংশের নকশা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাউবো। নকশা অনুমোদন হলে প্রকল্পের ব্যয় আরো একদফা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রকল্পের বিষয়ে উপকূলীয় ছনুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম হারুনুর রশিদ জানান, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কারণে এলাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে । মামলা হয়েছে, হাইকোর্টে রিট হয়েছে। কবে কাজ শুরু হবে জানি না । ঘূর্ণিঝড়ের কথা শুনলেই এলাকার জনগণের ঘুম হারাম হয়ে যায় বলেও জানান এ চেয়ারম্যান। গন্ডামারার চেয়ারম্যান এম লিয়াকত আলী জানান, আমার এলাকায় দুর্যোগে জনগণকে সচেতন করার সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে । তবে বাঁধ সর্বত্র সম্পন্ন হলে জনগণ সুফল পেত ।
খানখানাবাদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ বদরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমার এলাকায় বাঁধের কাজ শেষ পর্যায়ে। ফলে এলাকার জনগণ নিরাপদে রয়েছে । তবে ডাম্পিং ব্লকগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। সেগুলো ঠিক করে দেয়া হবে বলেও তিনি জানান । প্রকল্পের প্রথমদিকে ডাম্পিং এর জন্য বরাদ্দ্ রাখা না হলেও পরে ২২ কোটি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে । বাহারছড়ার চেয়ারম্যান এম তাজুল ইসলাম বলেন, বেড়িবাঁধের বাহারছড়া অংশের কাজ এখনো শেষ হয়নি । ফলে যে সব ব্লক এখানে এলোমেলো আছে তা যথাযথভাবে বসানো হবে।
সরেজমিন দেখা যায়, খানখানাবাদ অংশের কদমরসুল ও প্রেমাশিয়া অংশে বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। খানখানাবাদ অংশে বাঁধে মাটির কাজ চলছে। বাহারছড়ায় ব্লক বসানো হলেও তা জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুকুরিয়া অংশে শঙ্খ নদীর ভাঙন এলাকায় ব্লক বানানোর কাজ চলছে। সাধনপুরে মাটির কাজ শেষে ব্লক বসানোর কাজ চলছে। গন্ডামারায় মাটির কাজ শেষে এখন ব্লক বসানোর জন্য বাঁধ উপযোগী করা হচ্ছে। ছনুয়ায় আইনী ঝামেলায় ঠিকাদার কাজ বন্ধ রেখেছে। তবে বাঁধ নির্মাণে নানা ধরনের অনিয়ম অভিযোগ করেন উপকূলীয় এলাকার লোকজন।
এ বিষয়ে পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাঁধের কাজ করা যাচেছ না। জোয়ারে পানি প্রতিনিয়ত বাঁধে আঘাত হানায় ছনুয়া, খানাখানাবাদ এলাকায় কাজ করা যাচ্ছে না। ঠিকাদারের অনিয়মের প্রমাণ পেলেই টাস্কফোর্স সরাসরি কাজ বন্ধ করে দেবে। আমরা দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য ঠিকদারদের চিঠি দিয়েছি। ২০২০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন এ কর্মকর্তা।
আনোয়ারা প্রতিনিধি জানান, আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপকূলীয় এলাকার মানুষজনকে রক্ষায় ২৮০ কোটি ৩০ লাখ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পাউবো। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দুই উপজেলার ২ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে বলে জানান পাউবো’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের নানা অনিয়ম-অবহেলায় সময় মত মাটির কাজ , ব্লক ডাম্পিং শেষ হয়নি। উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধের বেহাল দশায় চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে আনোয়ারা উপকূলকে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এ কারণে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবেলায় বাড়তি প্রস্তুতির পাশাপাশি শংকাও থাকছে বলে এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
উপকূলীয় ইউনিয়ন রায়পুর, জুঁইদন্ডি, বারশত, বরুমচড়া, বারখাইন ইউনিয়ন ও আনোয়ারার (কর্ণফুলীসহ) নিম্নাঞ্চলের দুই লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে ।ইউনিয়নের বার আউলিয়া ও জুঁইদন্ডি ইউনিয়নের ২,৪,ও ৫ নং ওয়ার্ডে বেড়িবাঁধ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া বদলপুরা থেকে জুঁইদন্ডি পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ বেড়িবাঁধের বাইরে চরম ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
জানা গেছে , আনোয়ারার উপকূলীয় এলাকা রায়পুর, গহিরা, সরেঙ্গা, দক্ষিণ গহিরা, চুন্নাপাড়া, জুঁইদন্ডি, খুরুশকুল, পারকী ও বারশত এলাকার মানুষ ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। অনেকই বাড়িঘর ছেড়ে নিকটাত্মীয় ও নিরাপদ স্থানে চলে গেছে। রায়পুর ইউনিয়নের রেডক্রিসেন্ট কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল সোহান জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করলেও অধিকাংশ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে যেতে চাই না।
এ বিষয়ে রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানে আলম জানান, ইউনিয়নের অর্ধলক্ষ মানুষ ঝুঁকিতে বসবাস করছে। ঘূর্ণিঝড় আসলেই ব্যপক ক্ষতি সাধন হবে অত্র জনপদের বাসিন্দারা । জুইদন্ডির চেয়ারম্যান মোরশেদুল আলম খোকা জানান, ঠিকাদারের নানা অনিয়ম ও অবহেলায় সময়মত বেড়িবাঁধের মাটির কাজ ও ব্লক ডাম্পিং না করার কারণে ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ড অরক্ষিত আছে। ঝুঁকিতে বসবাস করছে ৩০ হাজার মানুষ।
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ জোবায়ের আহমদ জানান, চট্টগ্রামে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আনোয়ারা ও বাশঁখালী উপকূল।
উপকূল রক্ষায় সরকারের গৃহীত বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের ২৮০ কোটি ৩০ লাখ টাকার প্রকল্পে ২৫০ কোটি টাকার কাজ হবে আনোয়ারায়। বাকী কাজ হবে কর্ণফুলী উপজেলায়। ২০২০ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু যেভাবে কাজ চলছে তাতে অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়ের কথা শুনলেই উপকূলের মানুষের মনে ধরে ভয় ও আতঙ্ক এমনটিই জানালেন সংশ্লিষ্টরা
ছবিঃ আনোয়ারা জুইদন্ডি থেকে এনামুল হক নাবিদের তোলা।
0 মন্তব্যসমূহ