এম আলমঃ
‘হাঁটি হাঁটি পা পা/ যেখানে খুশি সেখানে যা’—ছড়ার এ দুটি লাইন ছোটবেলাতেই পড়েছেন মো. সামশুল হক (২৯)। লাইন দুটিকে নিজের জীবনেও সত্য বলে মেনেছেন তিনি। তবে হেঁটে নয়, ক্রাচে ভর দিয়ে যেখানে খুশি সেখানে গেছেন তিনি। এখন ছুটে চলেছেন বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় ফসলের মাঠে ও ফলের বাগানে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ক্রাচে ভর দিয়ে ছুটে চলা এই মানুষটি সেখানকার প্রায় ৬৫০ কৃষকের ভরসা হয়ে উঠেছেন।
সামশুল হক জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাঁর দুই পা ও দুই হাতের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়নি। শৈশবেই তাঁর সঙ্গী হয় এক জোড়া ক্রাচ। যখন বুঝতে শিখলেন এভাবেই চলতে হবে, তখন এই ক্রাচই হয়ে ওঠে তাঁর শক্তি।
সামশুলের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ছেলে প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাঁকেও নানাজনে নানা কথা বলেছে। পাড়া-প্রতিবেশী, এমনকি আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও অনেক অবহেলা সইতে হয়েছে সামশুলকে। কিন্তু তাঁর ছেলে দমে যাননি।
কৃষি ডিপ্লোমা পাস করার পর ২০১১ সালে সামশুল যোগ দেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাসে। সংস্থার খাদ্যনিরাপত্তা প্রকল্পের অধীনে মাঠসহায়ক কর্মকর্তার পদে চাকরি নেন। প্রথমে তাঁর কর্মস্থল ছিল খাগড়াছড়িতে। সেখানে এক বছর থাকার পর তাঁকে বদলি করা হয় বান্দরবানের আলীকদম কার্যালয়ে। এই কার্যালয় থেকে সেবা (কৃষি পরামর্শ) নেন ৫৯২ জন কৃষক। সামশুলকে প্রতিদিন স্বাভাবিক মানুষের মতোই পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পেরিয়ে মাঠে কৃষকের কাছে যেতেন। কার্যালয়টিতে তিনি ছাড়া আরও পাঁচজন মাঠসহায়ক কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরাও প্রতিদিন মাঠে যেতেন।
গত ২০১৭ সালের ২৪ মার্চ সামশুল আলীকদম উপজেলা সদরের আকবর আহমদপাড়ায় একটি আমবাগানে কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ফলন বাড়ানো এবং কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন তাঁরা। সেখানে কথা হয় কৃষক কামাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চার বছর ধরে আমরা তাঁর কাছ থেকে নানা বিষয়ে সহায়তা নিই। আমি সবজি ও আমের চাষ করি। কলাবাগানও আছে। ফলন কীভাবে বাড়ানো যায়, চারা কোনটি ভালো হবে—এসব বিষয় নিয়ে সামশু ভাই আমাদের পরামর্শ দেন।’
ছেনোয়ারা বেগম নামের এক নারী বলেন, ধান চাষের পাশাপাশি ফল ও সবজি চাষ করেন তিনি। কোন সময় কী বীজ ব্যবহার করলে, সারের পরিমাণ কেমন হলে ভালো হয়—এসব বিষয় নিয়ে সামশুল হকের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলেন তিনি।
২০১৮ থেকে পুনরায় ৬৫০ উপকারভোগী নিয়ে আলীকদমে ২২ পাড়া নিয়ে কারিতাস, এগ্রো ইকোলজি প্রকল্প কাজ শুরু করেন। কৃষককে প্রশিক্ষণ, ধান বীজ অর্থকরী আদা-হলুদ, বিভন্ন প্রকার সবজি বীজ পশু পালন ছাগল বিতরণ পরিবেশ বান্ধব চাষাবাদ করা হয়। প্রতি মাসে একটি করে কারিতাস কৃষি শিক্ষা মূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন চাষাবাদ সম্পর্কে হাতে কলমে কৃষকদেরকে শিক্ষা দেন শামশুল হক।
কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালক জেমস গোমেজ বলেন, সামশুল দক্ষ কর্মী। তাঁর কাজ অন্য অনেক স্বাভাবিক কর্মীর চেয়ে ভালো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কৃষকেরা তাঁকে দেখে প্রেরণা ও উৎসাহ পান।
সামশুলের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের ছনুয়া গ্রামে। বাবা সৈয়দুল হক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মা মনোয়ারা বেগম। এই দম্পতির চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে সামশুল তৃতীয়। সামশুলের পিঠাপিঠি ছোট ভাই আজিজুল হকও প্রতিবন্ধী। অষ্টম শ্রেণি পাস আজিজুল একটি উন্নয়ন সংস্থায় দরজি প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন।
মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম বেতন পাওয়ার পর বাড়ি এসে তাঁকে টাকা দিয়েছিলেন সামশুল। সেদিন অনেক কেঁদেছিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ছেলে একদিন নিজে আয় করে চলতে পারবেন।
মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম বেতন পাওয়ার পর বাড়ি এসে তাঁকে টাকা দিয়েছিলেন সামশুল। সেদিন অনেক কেঁদেছিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ছেলে একদিন নিজে আয় করে চলতে পারবেন।
নিজের স্বপ্ন ও সংগ্রামের বিষয়ে সামশুল বলেন, ‘যেহেতু প্রতিবন্ধী, তাই একটু দেরিতে লেখাপড়া শুরু করেছি। শিক্ষক বাবা সব সময় চাইতেন পড়ালেখা করি। কিন্তু ক্রাচে ভর দিয়ে যাওয়া-আসা কষ্টকর ছিল। তবু হাল ছাড়িনি। ২০০৬ সালে ছনুয়া কাদেরিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। এরপর ২০১০ সালে হাটহাজারী কৃষি ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করি।’ তিনি বলেন, পড়ালেখার ক্ষেত্রে, চলার পথে অনেক বন্ধুবান্ধব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
সামশুল আরো বলেন, ‘এই ক্রাচই আমার সঙ্গী। মনে জোর থাকলে এটি (প্রতিবন্ধিতা) কারও জন্য বাধা না।’ আমার মত এক প্রতিবন্ধিকে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালক জেমস গোমেজ স্যারকে আন্তরিক ভাবে আমার এবং আমার পরিবারের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। আমার মত শিক্ষিত বেকার প্রতিবন্ধিদেরকে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী সংস্থায় চাকুরীর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সরকারে কাছে বিনীত ভাবে আবেদন জানাচ্ছি। আমি স্ত্রীসহ এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বর্তমানে আলীকদমে বসবাস করছি। ২০০৬ সাল থেকে বাঁশখালীর ছনুয়া স্কুলের প্রয়াত সহকারী প্রধান শিক্ষক আলহাজ্ব মহসিন চৌধুরী স্যার আমাকে পড়ালেখার জন্য বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। প্রয়াত স্যারের প্রতি চির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি ও স্যারের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আমরা ৭ ভাই বোনের মধ্যে দু ভাই প্রতিবন্ধি। আরেক ভাইয়ের নাম আজিজুল হক। সে বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে দর্জির কাজ করেন।
0 মন্তব্যসমূহ