মুহাম্মদ শাহেদঃ
একটি নতুন ওষুধ বা ভ্যাকসিন তৈরি এবং প্রয়োগ বেশ সময়সাপেক্ষ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করার মধ্যেই এর সফলতা নিহিত। এবার মুল আলোচনায় ( Main discussion) আসা যাক: আমরা যদি সম্পূর্ণ কার্যপ্রণালীকে (Total procedure) চারটি পর্যায়ে ভাগ করি, প্রথম পর্যায় থেকে তৃতীয় পর্যায় পর্যন্ত অর্থাৎ ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার থেকে তা মানব দেহে পরীক্ষায় সময় লাগে প্রায় ৫-১০ বছর। পরবর্তীকালে, চারটি পর্যায়ে (Four stages) একটি নতুন ওষুধ বা ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগ উপযোগী হয়। প্রথম পর্যায় (1st Stage) : নতুন ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য নিরলস গবেষণা। দ্বিতীয় পর্যায় (2nd stage) (প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল/Pre-Clinical trials) : ওষুধ বা ভ্যাকসিনটি নিরাপদ (Safe) কি না তা দেখার জন্য গুটিকয়েক মডেল অরগানিসম (Model organisms) এর দেহে পরীক্ষা। সাধারণত ইঁদুর বা গিনিপিগ জাতীয় প্রাণির দেহে পরীক্ষা (Experiment) করা হয়ে থাকে। আশাবেঞ্জক ফলাফল (Successful results) যদি পাওয়া যায় তারপরে, তৃতীয় পর্যায় হল (3rd stage) (ক্লিনিকাল ট্রায়াল/ Clinical trials) : এই পর্যায় ওষুধ বা ভ্যাকসিনটি মানবদেহের জন্য নিরাপদ (Safe) ও কার্যকর (Effective) কি না যাচাই করা হয়। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মোটামুটিভাবে, তিনটি ধাপে (Three steps) সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রথম ধাপ (1st step) : সাধারনত ৫০ থেকে ১০০ জন রোগহীন মানুষের (Healthy individulals) শরীরে পরীক্ষা করা হয়। এই ধাপে দেখা হয়, নতুন ওষুধের মাত্রা বা ভ্যাকসিন ডোজ (Vaccine dose) সর্বোচ্চ কী পরিমাণে মানব শরীর নিতে পারে ও ওষুধ বা ভাক্সিন এর প্রতিক্রিয়া (Reactions) কতটা সময় ধরে মানবশরীরে বিরাজমান থাকে। দ্বিতীয় ধাপে (2nd step) সরাসরি নির্দিষ্ট রোগীদের (Patients) শরীরে পরীক্ষা করা হয়। এই ধাপে রোগ নিরাময়ক্ষমতার (Disease healing) পাশাপাশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects) এর ধরণ ও দেখা হয়। তৃতীয় ধাপে (3rd step) ওষুধটির কার্যকারিতা (Effectiveness) এবং অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Unexpected side effects) দেখা হয়। এই ধাপেই হল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এখানে প্রায় ১০০০ থেকে ৩০০০ এর ও বেশি রোগীর শরীরে পরিক্ষা করা হয়ে থাকে। একাধিক দেশ বা স্বেচ্ছাসেবকের উপর চালানো হয় এই পরীক্ষা। কার্যকারিতা, ডোজ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাচাইকরণ সহ আশাবেঞ্জক ফলাফলের নিমিত্তে চতুর্থ পর্যায়ে (4th stage) মানবদেহে ব্যবহারের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার (Drug regulatory organization) কাছে নতুন ওষুধ বাজারজাত করার আবেদন করা হয়।
এখন আসা যাক ভ্যাকসিন কি (What is Vaccine)? ভ্যাকসিন হচ্ছে একটি এজেন্ট (Agent) , রাসায়নিক যৌগ (Chemicals) বা জৈব-রাসায়নিক যৌগ (Organic compounds) যা শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় (Physiological process), কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিনথেটিক সংশ্লেষণের (Synthetic) মাধ্যমে তৈরি করা হয় যা একটি বিশেষ সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে ইম্যুনিটি (Immunity) বা প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদান করে থাকে। ভ্যাকসিনে সাধারণত যে এজেন্ট থাকে তা একটি রোগজনিত অণুজীবের (Disease causing organisms) অনুরূপ এবং এটি প্রায়ই জীবাণু, তার টক্সিন (Toxins) বা তার পৃষ্ঠতল (Surface) প্রোটিনগুলোর দুর্বল বা মৃত রূপ (Dead) থেকে তৈরি করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট (WHO report) অনুযায়ী বর্তমানে ভ্যাকসিনগুলো ২৫টিরও অধিক প্রাণঘাতী রোগের (Deadly diseases) বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। যার মধ্যে হাম, পোলিও, টিটেনাস, ডিপথেরিয়া, মেনিনজাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টিটেনাস, টাইফয়েড ও জরায়ুর ক্যান্সার রয়েছে। ভ্যাকসিনগুলোতে মৃত বা নিষ্ক্রিয় অণুজীব বা এগুলো থেকে উৎপন্ন বিশুদ্ধ উপাদান (Pure component) থাকে। বেশির ভাগ ভ্যাকসিনগুলো অণুজীব থেকে নিষ্ক্রিয় বা সংশ্লেষযুক্ত যৌগগুলো ব্যবহার করে তৈরি করা হয়, সিনথেটিক ভ্যাকসিনগুলো মূলত বা সম্পূর্ণ সিনথেটিক পেপটাইড (Peptides), কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrates) বা অ্যান্টিজেন (Antigens) সমন্বিত থাকে। ভ্যাকসিন উৎপাদনের সময় রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাটিকে নষ্ট করে দিয়ে অ্যান্টিবডি (Antibody) তৈরি ঠিক রাখা হয়। ফলে ভ্যাকসিন দেহে প্রবেশ করানোর পরে দেহে রোগের কারণ হয় না, উল্টো রোগটি যেন না হয় তার জন্য বিশেষ অ্যান্টিবডি তৈরি করতে থাকে। আরেকটি সুবিধা হলো এই জীবাণুগুলো মেমরি সেল (Memory cells) গঠন করে ফলে পরবর্তীতে একই জীবাণু আবার প্রবেশ (Secondary infection) করলে সহজে শনাক্ত করতে পারে।
সংক্রমণজনিত রোগের (Infectious diseases) ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়াকে সম্ননয় (Coordination) ও ত্বরান্বিত করতে ২০১৭ সালে বিভিন্ন দেশ এবং বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে অসলোভিত্তিক “The Coalition for Epidemic Preparedness Innovations (CEPI)” নামের একটি সংস্থার জন্ম হয়। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নরওয়ে, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মতো দেশের সাথে আছে বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন; আছে কিছু নামি ওষুধ কোম্পানি। CEPI এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভবিষ্যতে বিভিন্ন রোগের কথা চিন্তা করে প্রস্তুতি নেয়া এবং এ ধরনের রোগের মহামারী ঠেকানো। CEPI এরই মধ্যে নতুন করোনা ভাইরাসের (COVID-19) ভ্যাকসিন তৈরিতে চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (Center for Disease Control and Prevention, CDC), যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (National Health Institute, NIH), অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড (University of Queensland), যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডভিত্তিক ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নোভাভ্যাক্স (Novavax) ও পেনসালভানিয়ার বায়োটেক ফার্ম ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালসকে (Biotech Firm Inovio Pharmaceuticals) সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাস মুক্ত নতুন দিন ফিরে আসুক। জনজীবনে ফিরে আসুক নতুন প্রান ও নতুন উদ্যম। প্রকৃতিতে বাজুক সবুজের জয়গান। বাড়িতে থাকুন এবং নিরাপদে থাকুন।
0 মন্তব্যসমূহ